ভারতে উদার অর্থনীতির প্রবেশ তাঁর হাত ধরেই। ভারতীয় অর্থনীতির বহু আলোচিত, বহু বিতর্কিত ব্যক্তিত্ব তিনি। প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী, দেশের অর্থনৈতিক উদারীকরণের জনক মনমোহন সিংহ প্রয়াত। বয়সজনিত নানা অসুস্থতায় ভুগছিলেন তিনি। বৃহস্পতিবার তাঁকে ভর্তি করানো হয় দিল্লি এমসে। রাত ৮টা নাগাদ তাঁকে নিয়ে যাওয়া হয় হাসপাতালের জরুরি বিভাগে। রাতে হাসপাতালেই প্রয়াত হন ৯২ বছরের প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী।
ভারতের সংসদীয় গণতন্ত্রের ইতিহাস বলছে, এখনও পর্যন্ত জওহরলাল নেহরু, ইন্দিরা গান্ধী এবং নরেন্দ্র মোদী ছাড়া মনমোহনই দীর্ঘতম মেয়াদে প্রধানমন্ত্রী পদে ছিলেন। ২০০৪ থেকে ২০১৪। একটানা ১০ বছর। তার আগে সামলেছেন ১৯৯১ থেকে ১৯৯৬ পর্যন্ত নরসিংহ রাওয়ের প্রধানমন্ত্রিত্বে দেশের অর্থমন্ত্রীর দায়িত্বও। ছিলেন রাজ্যসভায় বিরোধী দলনেতা।
সংসদীয় রাজনীতিতে পা রাখার আগে রিজ়ার্ভ ব্যাঙ্কের গভর্নর, যোজনা কমিশনের ডেপুটি চেয়ারম্যান পদের দায়িত্বভার সামলেছেন দক্ষ হাতে। ১৯৮২ সালে রিজ়ার্ভ ব্যাঙ্ক অফ ইন্ডিয়ার গভর্নর নিযুক্ত হন মনমোহন। সেই সময় দেশের অর্থমন্ত্রী ছিলেন প্রণব মুখোপাধ্যায়।
দেশভাগের পর পরিবারের সঙ্গে শরণার্থী হয়ে চলে আসেন ভারতে। কৃতী ছাত্র, নামী শিক্ষক, উচ্চপদে নানা চাকরি থেকে শুরু করে দেশের সর্বোচ্চ প্রশাসনিক পদে উঠে আসা— সব মিলিয়ে মনমোহনের জীবন এক চমকপ্রদ উত্থানের কাহিনি। অবিভক্ত পঞ্জাবের প্রত্যন্ত এক গ্রামে শিখ পরিবারে জন্মেছিলেন মনমোহন। মনমোহনের জন্মস্থান বর্তমান পাকিস্তানের পঞ্জাব প্রদেশের চকওয়াল জেলার গাহ গ্রাম। জন্মদিন ১৯৩২ সালের ২৬ সেপ্টেম্বর।
অল্প বয়সে মাকে হারান। ঠাকুমার কাছেই মানুষ হন মনমোহন। প্রথমে উর্দু মাধ্যম স্কুলে শিক্ষা। দেশভাগের সময় ১৯৪৮ সালে কিশোর মনমোহন পরিবারের হাত ধরে চলে আসেন অমৃতসরে। এখানে এসে হিন্দু কলেজে ভর্তি হন তিনি। ১৯৪৮ সালে পঞ্জাব বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ম্যাট্রিকুলেশন পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন। পড়াশোনায় বরাবরই মেধাবী ছিলেন কৃষক পরিবার থেকে উঠে আসা প্রয়াত এই প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী।
১৯৫২ সালে অর্থশাস্ত্রে স্নাতক হন। এবং ১৯৫৪ সালে স্নাতকোত্তর ডিগ্রি অর্জন করেন। পঞ্জাব বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনার পাট চুকিয়ে মনমোহন পাড়ি দেন বিদেশে। সংবাদমাধ্যমের সূত্র বলছে, ক্লাসে কখনও দ্বিতীয় হননি মনমোহন। শিক্ষাগত যোগ্যতার নিরিখে সবচেয়ে শিক্ষিত প্রধানমন্ত্রীর কথা উঠলেই পাগড়ি পরা মিতভাষী মনমোহনের চেহারাই ভেসে ওঠে চোখের সামনে।
স্নাতকোত্তর শেষ করার পর কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ে অর্থনীতি নিয়ে পড়াশোনা করেন। সেখান থেকে ফার্স্ট ক্লাস পেয়ে নজির গড়েন। তার পর ১৯৬২ সালে অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের নাফিল্ড কলেজ থেকে ‘ডক্টর ফিল’ ডিগ্রিও অর্জন করেন। চোখ ধাঁধানো ফলাফলের জন্য তিনি ‘স্কলারশিপ’ অর্জন করেন। মুষ্ঠিমেয় মেধাবী প্রাপকদের মধ্যে মনমোহন ছিলেন অন্যতম।
দরিদ্র কৃষক পরিবারে বেড়ে ওঠা মনমোহনের পরিবারের সামর্থ্য ছিল না তাঁকে বিদেশে পড়ানোর। প্রতিটা পরীক্ষায় স্কলারশিপ পেয়েই তাঁকে পড়াশোনা চালিয়ে যেতে হয়। কেমব্রিজে পড়ার সময়, অর্থের অভাব তাঁকে যথেষ্ট বিচলিত করেছিল বলে একটি বইয়ে জানিয়েছেন মনমোহনের কন্যা দমন সিংহ। তিনি লিখেছেন, পঞ্জাব বিশ্ববিদ্যালয়ের ১৫০ পাউন্ড স্কলারশিপে বছরে ৬০০ পাউন্ড খরচ চালানো দুষ্কর হয়ে পড়েছিল তাঁর বাবার।
মনমোহন নিজেও স্বীকার করে নিয়েছিলেন স্কলারশিপের ভরসাতেই তিনি বিদেশে পড়তে পেরেছেন। ২০০৪ সালে আমেরিকার এক সংবাদমাধ্যমের পক্ষ থেকে তাঁকে প্রশ্ন করা হলে মনমোহন বলেন, তিনি ‘বৃত্তি ব্যবস্থার পণ্য’। কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ে এবং তার পরে অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষার জন্য তিনি কী ভাবে লন্ডনে যেতে পেরেছিলেন জানতে চাওয়া হলে দেশের এই অর্থনীতিবিদ বলেছিলেন, ‘‘এটি আমাদের বৃত্তি ব্যবস্থার কৃতিত্ব।’’
তিনি সাক্ষাৎকারে বলেন, ‘‘আমার হাতে থাকা সম্পদের ভিত্তিতে আমি কখনওই অক্সফোর্ড বা কেমব্রিজে যেতে পারতাম না। আমার বাবা-মা আমাকে পাঠাতে পারেননি। কিন্তু আমি পরীক্ষায় ভাল ফল করেছি, তাই বৃত্তি অর্জন করতে পেরেছি।’’ তিনি আরও বলেন, ‘‘কেমব্রিজ এবং অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয় আমাকে একটি ফেলোশিপ দিয়েছে, তাই আমি বৃত্তি ব্যবস্থার পণ্য।’’
এত বিষয় থাকতে অর্থনীতিকেই কেন বেছে নিয়েছিলেন মনমোহন? তার জবাবে তিনি জানিয়েছিলেন, চার পাশে দারিদ্র দেখে বড় হয়েছিলেন তিনি। কেন এত দারিদ্র, ভারত এত দরিদ্র দেশ কেন, এত আর্থিক দুর্দশার কারণ কী, এই প্রশ্নগুলিই তাঁকে অর্থনীতির দিকে ঝুঁকতে বাধ্য করে।
বিদেশ থেকে একের পর এক সম্মান ঝুলিতে পুরে দেশে ফিরে তাঁর কর্মজীবন শুরু হয় অধ্যাপক হিসাবে। সেখান থেকে ১৯৬০ সালে, ভারতের বাণিজ্য মন্ত্রকের উপদেষ্টা হিসাবে কাজ শুরু করেন প্রয়াত কংগ্রেস নেতা। প্ল্যানিং কমিশনের ডেপুটি চেয়ারম্যান, আরবিআইয়ের সর্বময় কর্তা হয়ে দায়িত্ব সামলান।
মনমোহন সিংহ নামটা দেশ তথা বিশ্বের নজরে এসে পড়ে ১৯৯১ সালে, তিনি দেশের অর্থমন্ত্রী হওয়ার পর। নরসিংহ রাওয়ের জমানায় অর্থমন্ত্রী হিসাবে দেশের আর্থিক সংস্কার কর্মসূচির সঙ্গে একাকার হয়ে গিয়েছে মনমোহনের নাম। অর্থনীতির সব গুরুত্বপূর্ণ ক্ষেত্রে পুরোদস্তুর সরকারি নিয়ন্ত্রণ সরিয়ে বেসরকারি পুঁজি, ক্ষেত্রবিশেষে বিদেশি পুঁজিকেও জায়গা করে দেওয়ার রাস্তা তৈরি হয়েছিল মনমোহনের হাতে।
পাঁচ বছর অর্থমন্ত্রী থাকাকালীন বহু বিতর্কের কেন্দ্রে ছিলেন তিনি। এক দিকে প্রবল নিন্দা আর প্রতিবাদ, অন্য দিকে দু’হাত তুলে প্রশংসা আর সমর্থন, দুই-ই জুটেছে তাঁর।
বিজেপি নেতৃত্ব তাঁর মিতভাষী স্বভাবকে কটাক্ষ করে বার বার ‘মৌনীমোহন’ বা ‘দুর্বল প্রধানমন্ত্রী’ বললেও দেশি-বিদেশি সংবাদমাধ্যমের কাছে এই ‘সিং’ ছিলেন ‘কিং’।
ভারতের ইতিহাসে মনমোহনই একমাত্র প্রধানমন্ত্রী যিনি আগে নিজের অবসরের কথা ঘোষণা করেছিলেন। ২০১৪-র লোকসভা নির্বাচনের পাঁচ মাস আগে জানিয়ে দিয়েছিলেন, ভোটের ফলাফল যা-ই হোক না কেন, তিনি আর প্রধানমন্ত্রী পদে থাকবেন না।
শারীরিক অসুস্থতার কারণে গত কয়েক বছর ধরে সক্রিয় রাজনীতি থেকে দূরে ছিলেন তিনি। চলতি বছরের জানুয়ারিতে একটি বই প্রকাশ অনুষ্ঠানে শেষ বার জনসমক্ষে দেখা গিয়েছিল তাঁকে। আক্ষরিক অর্থেই নীল পাগড়ির সর্দারজি ছিলেন ‘লাস্ট অফ দ্য মোহিকান্স’। তাঁর জীবনাবসানে ভারত হারাল এক বিরল ভদ্র, শিক্ষিত এবং নম্র রাজনীতিককে। এমনটাই মনে করছে দেশের রাজনৈতিক মহল।