ছবি: সংগৃহীত।
আলু, পেঁয়াজ, টোম্যাটো, ডাল, তৈলবীজ, ভোজ্য তেল ১৯৫৫-র অত্যাবশ্যক পণ্য আইনের আওতার বাইরে আনার সিদ্ধান্ত নিয়েছে কেন্দ্রীয় সরকার। কেন্দ্রীয় অর্থমন্ত্রী নির্মলা সীতারামন অত্যাবশ্যক পণ্য আইন সংশোধন করে আলু-পেঁয়াজ, ডাল, তেলের কেনা-বেচা, আন্তর্রাজ্য পরিবহণ এবং মজুতদারির উপর যাবতীয় নিয়ন্ত্রণ তুলে দেওয়া হবে বলে ঘোষণা করেছেন। এর ফলে রাজ্যের প্রশাসনিক মহলে আশা-আশঙ্কা দুই-ই তৈরি হয়েছে।
কারণ, ১০ কোটি রাজ্যবাসীর পেঁয়াজ, ডাল, তৈলবীজ, ভোজ্য তেলের যে চাহিদা, তার তুলনায় এখানে উৎপাদন কম হয়। ফলে ভিন্ রাজ্য বা দেশ থেকে অবাধে ডাল-তেল চাহিদা অনুযায়ী এনে মজুত রাখা হলে বছরভর দাম নিয়ন্ত্রণে থাকবে। কিন্তু আলু উৎপাদনে রাজ্য স্বাবলম্বী। ভিন্ রাজ্যেও এখান থেকে আলু যায়। নিয়ন্ত্রণ উঠে যাওয়ার ফলে আলু উৎপাদকেরা ভিন্ রাজ্যের ব্যবসায়ীদের কাছে তুলনামূলক বেশি দামে আলু বিক্রি করে দিলে, রাজ্যে আলুর দাম বাড়ার আশঙ্কা রয়েছে।
যদিও কৃষি দফতরের একাংশের অভিমত, কেন্দ্রীয় সরকারের এই ঘোষণায় কিছুই হেরফের হবে না। এখনও আলু কেনা-বেচা, মজুতদারির উপর সরকারের কোনও নিয়ন্ত্রণ নেই। গত ১০ বছরে একবারও আলুর উপর অত্যাবশ্যক পণ্য আইন প্রয়োগ করতে হয়নি। হঠাৎ দাম বেড়ে যাওয়ায় ২০১৪ সালে প্রশাসনিক আদেশে ভিন্ রাজ্যে আলু পাঠানো নিয়ন্ত্রণ করা হয়েছিল। ২০১৯-এ পেঁয়াজের দাম প্রতি কিলোগ্রাম ১০০ টাকা হয়ে যাওয়ায় রাজ্য নয়, কেন্দ্রীয় সরকার অত্যাবশ্যক পণ্য আইন প্রয়োগ করতে বলেছিল। কিন্তু তার পরেও এ রাজ্যে কেউ গ্রেফতার হননি। সে সময় এ রাজ্যে মজুতদারির কোনও প্রমাণ মেলেনি।
আরও পড়ুন: ‘জানি না, গণেশের কী হয়েছে’, দুর্ঘটনাগ্রস্ত ট্রাকের যাত্রী
রাজ্যের কৃষি দফতরের উপদেষ্টা প্রদীপ মজুমদারের মতে, ‘‘আগে আইন সংশোধন হোক। তার পর মতামত দেব। মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় কৃষক-দরদী, তাঁদের স্বার্থ তিনি রক্ষা করবেন।’’
কৃষি কর্তারা জানাচ্ছেন, ডাল বা তেলের চাহিদা হঠাৎ করে বেড়ে বা কমে যায় না। কারণ, কোনও পরিবারে ডাল-তেলের ব্যবহার সামঞ্জস্যপূর্ণ ভাবেই বাড়ে। তাই উৎপাদন একেবারে মার না খেলে ডাল-তেলের বাজারে ফাটকাবাজি বা মজুতদারি কম হয়। রাজ্যে ডালের উৎপাদন কম, পাশাপাশি উত্তর-পূর্ব ভারত, নেপাল, ভুটানের ডালও কলকাতা হয়ে যায়। সেই কারণে কলকাতায় ডালের মজুতদারি ভালই হয়। এখন নিয়ন্ত্রণ উঠে যাওয়ায় তা আরও ভাল হবে। পেঁয়াজও আসে মূলত নাশিক থেকে। এখানকার ব্যবসায়ীরা তা ফসল ওঠার সময় রাজ্যে এনে মজুত করে নিতে পারলে সমস্যা হওয়ার কথা নয়।
আরও পড়ুন: ভাড়া বাড়ছে না বলে বেসরকারি বাস-মিনিবাস পথে নামার আপাতত সম্ভাবনা নেই
আলু নিয়ে কিছু আশঙ্কাও থাকছে। কৃষি ও কৃষি-বিপণনের কর্তারা জানাচ্ছেন, আলু এখন মাঠ থেকে সরাসরি রাজ্যের কোল্ড স্টোরেজেই মজুত হয়। ছোট চাষিদের আলু ফড়েরা কিনে নিয়ে যায়। বড় আলু চাষিরা নিজেরাই স্টোরে আলু রাখেন। বাজার বুঝে বিক্রি করেন। ছোট চাষিদের থেকে আলু কিনে যে ব্যবসায়ীরা রাজ্যের আলুর বাজার নিয়ন্ত্রণ করেন, তাঁরাই ভিন্ রাজ্যে আলু পাঠান। এর বাইরে বর্ধমান ও হুগলির কিছু অঞ্চলে দু’তিনটি বহুজাতিক সংস্থা সরাসরি চাষিদের সঙ্গে আলুর চুক্তি চাষও শুরু করেছে।
কৃষি কর্তাদের আশঙ্কা, যদি আলুর পরিবহণ ও মজুতদারিতে দেশ জুড়ে কোনও নিয়ন্ত্রণ না থাকে, তা হলে আলু উৎপাদক রাজ্যগুলি (পশ্চিমবঙ্গ, উত্তরপ্রদেশ, পঞ্জাব) থেকে ফসল ওঠার সময় ভিন্ রাজ্যের ব্যবসায়ীরা আলু কিনে নিয়ে যেতে পারেন। সে ক্ষেত্রে স্থানীয় ব্যবসায়ীদের চেয়ে ভিন্ রাজ্যের ব্যবসায়ীরা বাড়তি দাম দিলে চাষিরা তাঁদেরই আলু বিক্রি করবেন। এ ভাবে ফসল ওঠার সময়ই মাঠ থেকে আলু ভিন্ রাজ্যে গিয়ে মজুত হয়ে যেতে পারে। যে ভাবে নাশিকের পেঁয়াজ এখন এ রাজ্যে মজুতের ক্ষেত্রে কোনও বাধা থাকবে না, তেমনই এখানকার আলু গুজরাত, মহারাষ্ট্রে মজুত হওয়াও সম্ভব। সে ক্ষেত্র এ রাজ্যে উৎপাদিত হলেও দাম বাড়তে পারে। পাশাপাশি চাষিরাও সরাসরি বেশি দামে ফসল বিক্রির সুযোগ পেতে পারেন। চুক্তি চাষেও আরও অনেক সংস্থা নামতে পারে বলে মনে করছেন কৃষি কর্তারা।
পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনতে রাজ্যে করণীয় কি? নবান্নের অভিমত হল, খোলা বাজারের অর্থনীতিতে পণ্যের বিক্রিবাটায় নিয়ন্ত্রণ সম্ভব নয়। সরকার কে বরং তেল, ডালের জন্য আরও বেশি গুদাম তৈরি এবং পচনশীল পণ্যের কোল্ড চেনের পরিকাঠামো আরও মজবুত করতে হবে। তার ফলে বেঙ্গালুরুর টোম্যাটো যেমন সিঙ্গুরে মজুত করে রাখা যাবে, আবার তেমনই ঘরের আলু বাইরে যাবে কম।