কেন্দ্রীয় দূষণ নিয়ন্ত্রণ পর্ষদের তথ্য বলছে, ‘জনতা কার্ফু’র ঠিক এক দিন আগে অর্থাৎ ২১ মার্চ শনিবার প্রায় সব জনবহুল শহরে বায়ু দূষণের মাত্রা বিপজ্জনক ছিল।
বাতাসে দূষণের পরিমাণ এক ধাক্কায় অনেকটা কমে গেল। গত সপ্তাহে কলকাতা শহরে দূষণের যে মাত্রা ছিল, তা কমে গিয়েছে অনেকটাই। শুধু কলকাতা নয়, দেশের অন্যান্য শহরেরও একই অবস্থা। এমনটাই জানাচ্ছে কেন্দ্রীয় দূষণ নিয়ন্ত্রণ পর্ষদের রিপোর্ট।
গত রবিবার, ২২ মার্চ প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী ‘জনতা কার্ফু’র ডাক দিয়েছিলেন। গত সোমবার বিকেল থেকে এ রাজ্যে লকডাউন ঘোষণা করেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। তার পর মঙ্গলবার ফের প্রধানমন্ত্রী আগামী ১৪ এপ্রিল পর্যন্ত দেশ জুড়ে লকডাউন ঘোষণা করেন। কেন্দ্রীয় দূষণ নিয়ন্ত্রণ পর্ষদের তথ্য বলছে, ‘জনতা কার্ফু’র ঠিক এক দিন আগে অর্থাৎ ২১ মার্চ শনিবার দেশের প্রায় সব জনবহুল শহরে বায়ু দূষণের মাত্রা বিপজ্জনক ছিল। এক সপ্তাহ পর সেই ছবিটা অনেকটাই বদলে গিয়েছে।
আরও পড়ুন: লকডাউনের সময় বন্ধু সহ নয়জনের হাতে গণধর্ষণের শিকার ১৬ বছরের নাবালিকা
২৬ মার্চ বিকেল ৪টের সময় কেন্দ্রীয় দূষণ নিয়ন্ত্রণ পর্ষদের ‘বাতাসের গুণমানের সূচক’ (এয়ার কোয়ালিটি ইন্ডেক্স)-এ গড়ে দিল্লির বায়ুদূষণ সন্তোষজনক পর্যায়ে নেমে হয়েছে ৯২। কলকাতায় তা আরও কমে গিয়ে হয়েছে ৮৬। গুণমানের এই সূচকটি নির্ভর করে বাতাসে ভাসমান সূক্ষ্ম ধূলিকণার পরিমাণ (পিএম-১০) এবং অতি সূক্ষ্ম ধূলিকণার পরিমাণ (পিএম ২.৫)-এর উপরে। ফুসফুসের ক্ষেত্রেও সব থেকে বিপজ্জনক এই অতি সূক্ষ্ম ধূলিকণা। কলকাতায় রবীন্দ্রভারতী বিশ্ববিদ্যালয় অঞ্চল এবং ভিক্টোরিয়া মেমোরিয়াল চত্বরে ওই ধূলিকণা মাপার যন্ত্র রয়েছে। বিটি রোডের উপর রবীন্দ্রভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ের কাছে গত কয়েক দিনে সকাল ১০টায় বাতাসে ভাসমান অতি সূক্ষ্ম ধূলিকণার পরিমাণ (পিএম ২.৫) ছিল প্রতি ঘন মিটারে ১০০ মাইক্রোগ্রামের নীচে। ভিক্টোরিয়া মেমোরিয়াল চত্বরে ছিল আরও কম। মার্চ মাসের মাঝামাঝি সময়েও কিন্তু ওই দুই জায়গায় ধূলিকণার মাত্রা বিপজ্জনক অবস্থাতেই ছিল। হাওড়ার মতো শহরেও সূচক নেমেছে ৭১-এ।
মুম্বই এবং চেন্নাইয়ে ওই সূচক হয়েছে যথাক্রমে ৬৯ এবং ৫৬। গুণমানের সূচক অনুযায়ী এই মান ১০০-র নীচে হলে, তা সন্তোষজনক ধরা হয়। ১০১ থেকে ২০০-র মধ্যে এই সূচক পৌঁছে গেলেই তা বিপজ্জনকের দিকে যেতে শুরু করে। ২০১ থেকে ৩০০ খারাপ, ৩০১ থেকে ৪০০ অতি খারাপ, ৪০১ থেকে ৫০০ ভয়ঙ্কর খারাপ।
কিন্তু ঠিক এক সপ্তাহ আগে, গত শনিবার, ‘জনতা কার্ফু’র এক দিন আগে এই শহরগুলিতে দূষণ সূচক ১০০ ছাড়িয়ে গিয়েছিল। দিল্লিতে ছিল ‘বাতাসের গুণমানের সূচক’ ১৮৬, কলকাতা ১২৮, বেঙ্গালুরু ১০৫, নয়ডা ১৬১, গুরুগ্রাম ১২৬। এই হিসেব থেকে বোঝা যাচ্ছে কত দ্রুত পাল্টে গিয়েছে শহরগুলির ছবি।
এই মাত্রা বিপজ্জনকে পৌঁছে গেলেই, তা ফুসফুস, হার্ট এবং স্বাস্থ্যের জন্য একেবারেই ভাল নয়। এই দূষণের ফলে শিশু এবং বয়স্করা মারাত্মক ভাবে শারীরিক সমস্যায় ভুগতে পারেন। শ্বাসকষ্ট, অ্যালার্জি এবং ত্বকের সমস্যা হতে পারে। দেশের অন্যান্য শহরের মধ্যে গুরুগ্রামে ‘বাতাসের গুণমানের সূচক’ ৬১, জয়পুর ৫২, নয়ডা ৭২। চণ্ডীগড়ের সূচক অনেকটা নেমে ৪০-এ দাঁড়িয়েছে। ওই সূচকে ভাল পর্যায়ে রয়েছে লুধিয়ানা ৩৪, কোচি ৪২। দেশের বিভিন্ন প্রান্তে আরও বেশ কিছু শহর ভাল পর্যায়েই রয়েছে। হাতে গোনা কয়েকটি শহরে বাযুদূষণ বিপজ্জনক পরিস্থিতিতে রয়েছে।
লকডাউন ঘোষণার পর থেকে কল-কারখানা প্রায় বন্ধ। রাস্তায় কোনও গাড়ি নেই। অযথা হর্নের আওয়াজ নেই। চার দিক সুনসান। কলকাতার পার্ক স্ট্রিট থেকে ধর্মতলা— শহরের প্রায় সর্বত্রই পাখির কিচিরমিচির শব্দ। নতুন করে যেন অক্সিজেন ফিরে পেয়েছে শহর। করোনার কারণে আইসোলেশনে থাকা কলকাতায় দূষণের বিষ কমেছে অনেকটাই। বিজ্ঞানী থেকে চিকিৎসক বা পরিবেশকর্মী— সকলেই বলছেন, আদর্শ পরিবেশ এমনটাই হওয়া উচিত। এক বিজ্ঞানীর কথায়, ‘‘আমরাই তো পরিবেশকে নষ্ট করে নিজেদের বিপদ ডেকে এনেছি। হয়তো তার মাসুল দিতে হচ্ছে এখন।”
আরও পড়ুন: তিন মাসের ইএমআই কি মকুব? সব ব্যাঙ্ক দেবে? রইল সব প্রশ্নের উত্তর
লকডাউনের জেরে এ ভাবেই রাস্তাঘাট শুনশান হয়ে পড়েছে।
ভাইরোলজিস্ট অমিতাভ নন্দী বলেন, ‘‘দূষণ কম হলে স্বাভাবিক ভাবে সুস্থ থাকা যায়। ফুসফুসে সংক্রমণ হতেই পারে, তবে, দূষণ কম থাকলে জটিলতা অনেকটাই কম হয়। করোনাভাইরাসের ক্ষেত্রে দেখা গিয়েছে, আমেরিকা বা ইটালিতে বেশির ভাগ আক্রান্তেরই ফুসফুসে সংক্রমণ হয়ে জটিলতা বেড়েছে। এখন যেমন দূষণহীন রয়েছে, সেটা থাকাটা খুব জরুরি।’’
এ বিষয়ে পরিবেশবিদ সুভাষ দত্ত বলেন, “করোনা আমাদের বিপদ ডেকে এনেছে ঠিকই, কিন্তু আমারা যে ভাবে পরিবেশকে ক্ষতি করছিলাম, অযথা হর্ন বাজাতাম, গাছ কাটতাম, গাড়ির কালো ধোঁয়ায় ঢেকে ফেলতাম শহর— আর তা হচ্ছে না। এ অনেকটা উপোস বা রোজার মতোই। আমরা করোনা আতঙ্কে ঘরে রয়েছি। তাই পরিবেশ এতটা সচেজ হয়ে উঠেছে। এমনই তো হওয়া উচিত ছিল।”
—নিজস্ব চিত্র।