কেন্দ্রের চিঠি পেয়ে তৎপর নবান্ন। গ্রাফিক: শৌভিক দেবনাথ।
দীর্ঘ দিন ধরেই ১০০ দিনের কাজের টাকা কেন্দ্র দিচ্ছে না বলে অভিযোগ জানিয়ে আসছে নবান্ন। অন্য দিকে, কেন্দ্রের দাবি, সঠিক হিসাব দিতে না পারাতেই রাজ্যের প্রাপ্য আটকে দেওয়া হয়েছে। রাজ্যকে কিছু ব্যবস্থাও নিতে বলেছিল কেন্দ্রীয় গ্রামোন্নয়ন মন্ত্রক। সেই ব্যবস্থা কেমন নেওয়া হয়েছে তা জানিয়ে ‘অ্যাকশন টেকন রিপোর্ট’ পাঠিয়েছিল রাজ্য। কিন্তু সেই রিপোর্টও কেন্দ্রের মনঃপূত হয়নি। পশ্চিমবঙ্গের ১৫টি জেলার রিপোর্ট নিয়ে প্রশ্ন তুলে কেন্দ্রের তরফে চিঠি এসেছে বৃহস্পতিবার। এর পরেই কালবিলম্ব না করে ওই ১৫ জেলার জেলাশাসককে চিঠি পাঠিয়েছে নবান্ন। বলা হয়েছে, আগামী ১৪ নভেম্বরের মধ্যে কেন্দ্রের চাহিদামতো শর্তপূরণ করে নতুন ‘অ্যাকশন টেকন রিপোর্ট’ পাঠাতে হবে।
এমনিতেই অর্থসঙ্কট চলছে রাজ্যের। এখন গোদের উপরে বিষফোঁড়ার মতো এসে হাজির হয়েছে কেন্দ্রের এই চিঠি। রাজ্য বিজেপির তরফে অনেক দিন ধরেই পঞ্চায়েত স্তরে ‘চুরি’ চলছে বলে অভিযোগ তোলা হয়ে আসছে। কেন্দ্রীয় সরকারের কাছে এ নিয়ে লিখিত ভাবেও অভিযোগ জানান গেরুয়া শিবিরের নেতারা। ১০০ দিনের কাজের জন্য দেওয়া কেন্দ্রীয় সরকারের টাকা অন্য প্রকল্পে খরচ করা হচ্ছে, এমন নানা দুর্নীতির অভিযোগ তোলা হয়। সেই অভিযোগের প্রেক্ষিতে কয়েক মাস আগে কেন্দ্র পর্যবেক্ষক দল পাঠায় রাজ্যে। সেই দলও নানা অনিয়মের অভিযোগ তোলে এবং রাজ্যকে তা শোধরানোর কথা বলে। রাজ্য কী কী করছে, তা জানিয়ে রিপোর্টও জমা দিতে বলা হয়।
রাজ্য সরকারের তরফে সেই মতো রিপোর্ট জমা দেওয়া হয়েছিল গত সেপ্টেম্বরে। তবে সেই রিপোর্টেও ‘খুশি’ নয় কেন্দ্র। তা জানিয়ে গত ৩ নভেম্বর রাজ্যের পঞ্চায়েত ও গ্রামোন্নয়ন সচিবকে চিঠি পাঠিয়েছেন কেন্দ্রীয় সরকারের পক্ষে ১০০ দিনের কাজ প্রকল্পের ডিরেক্টর ধর্মবীর ঝা। শনিবার নবান্ন সূত্রে জানা গিয়েছে, সেই চিঠিতে বলা হয়েছে রিপোর্ট সঠিক ভাবে পাঠানো হয়নি। আরও বিশদ রিপোর্ট পাঠাতে হবে। দুই ২৪ পরগনা, নদিয়া, মুর্শিদাবাদ, দুই মেদিনীপুর, ঝাড়গ্রাম, বীরভূম, বাঁকুড়া, পুরুলিয়া, দুই দিনাজপুর, কোচবিহার, আলিপুরদুয়ার এবং কালিম্পং জেলার রিপোর্ট নিয়ে প্রশ্ন তুলেছে কেন্দ্র।
এর পরেই শুক্রবার, ৪ নভেম্বর রাজ্যের ১০০ দিনের কাজ প্রকল্পের কমিশনার একটি চিঠি পাঠিয়েছেন ১৫টি জেলার জেলাশাসককে। সেখানে বলা হয়েছে, রাজ্যের তরফে জমা দেওয়া ১৫টি জেলার ‘অ্যাকশন টেকন রিপোর্ট’ নিয়ে খুশি নয় কেন্দ্রীয় সরকার। সেই মর্মে চিঠি পাঠিয়ে কিছু ব্যবস্থা নেওয়ার নির্দেশও দেওয়া হয়েছে। সকলকে সেই সব নির্দেশ পালন করে ১৪ নভেম্বরের মধ্যে নবান্নে নতুন করে ‘অ্যাকশন টেকন’ রিপোর্ট পাঠাতে হবে।
নবান্ন সূত্রে এ-ও জানা গিয়েছে যে, ১০০ দিনের কাজে যে ‘দুর্নীতির’ অভিযোগ রয়েছে, তার বিরুদ্ধে কী কী ব্যবস্থা নিতে হবে, তা-ও উল্লেখ করে দিয়েছে কেন্দ্রীয় সরকার। বলা হয়েছে, ১০০ দিনের কাজের আওতায় জমি-উন্নয়ন প্রকল্পের ঢালাও অনুমতি দেওয়া বন্ধ করতে হবে। অভিযোগ, মাটি ফেলার নামে অনেক টাকা সরানো হয়েছে। ইতিমধ্যেই ওই ভাবে যে পরিমাণ টাকা লোপাট হওয়ার অভিযোগ উঠেছে, তা উদ্ধার করতে হবে। যে সব কর্মী ওই ‘দুর্নীতিতে’ যুক্ত ছিলেন বা আছেন, তাঁদের বিরুদ্ধেও পদক্ষেপ করতে হবে। ১০০ দিনের কাজ প্রকল্পের টাকা অন্য খাতে খরচ করায় অভিযুক্তদের বিরুদ্ধেও শৃঙ্খলাভঙ্গের অভিযোগে পদক্ষেপ করতে হবে। পরিস্থিতি যে দিকে গিয়েছে, তাতে এখন কেন্দ্রের নির্দেশমতো ব্যবস্থা নিয়ে এবং নতুন করে ‘অ্যাকশন টেকন রিপোর্ট’ পাঠিয়েও কেন্দ্রের মন পাওয়া যাবে কি না, তা নিয়ে সম্পূর্ণ আশাবাদী নয় নবান্ন। প্রশাসনিক আধিকারিকদের একাংশ মনে করছেন, বিষয়টি এখন ‘রাজনৈতিক লড়াই’-এর স্তরে চলে গিয়েছে।
প্রসঙ্গত, কেন্দ্রীয় সরকার বিভিন্ন প্রকল্প বাবদ রাজ্যের প্রাপ্য সময়মতো মেটাচ্ছে না বলে তৃণমূল তো বটেই, বিভিন্ন সময়ে সরব হয়েছেন স্বয়ং মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ও। ১০০ দিনের কাজের টাকা না পাওয়া নিয়ে আন্দোলনের হুঁশিয়ারিও দেন তিনি। গত ৩০ মে মমতা বলেছিলেন, ‘‘পাঁচ মাস এই টাকা বন্ধ রেখে নোংরা রাজনৈতিক খেলা খেলছে কেন্দ্রীয় সরকার। এটা আমাদের প্রাপ্য।’’ দলের কর্মীদের নির্দেশ দিয়ে মমতা সে দিন বলেছিলেন, ‘‘কেন মানুষ ১০০ দিনের কাজের টাকা পাচ্ছেন না? ‘বিজেপি জবাব দাও, প্রধানমন্ত্রী জবাব দাও’, এই স্লোগানে গ্রাম ও শহরে আন্দোলন হবে।’’
অন্য দিকে, বিজেপির তরফে তার জবাব দিয়েছিলেন স্বয়ং সর্বভারতীয় সভাপতি জেপি নড্ডা। তিনি কলকাতায় এসে বলেছিলেন, ‘‘তিন বছর ধরে কেন্দ্রকে এই প্রকল্পের হিসাব পাঠায়নি রাজ্য। মমতাদিদি কি হিসাব দিতে ভুলে গিয়েছেন?’’ সঙ্গে নড্ডার সংযোজন ছিল, ‘‘যে কোনও প্রকল্পের টাকা পেতে গেলে সময়ে হিসাব দিতে হয়। কেন্দ্র যদি হিসাব না পেয়ে টাকা পাঠায়, তবে সেটা ভুল হবে। সেই ভুল করবে না কেন্দ্রীয় সরকার।’’