ভবিষ্যৎ অনিশ্চিত। মাকুর সামনে মূলচাঁদ শেখ। —নিজস্ব চিত্র
সুনসান তাঁতিপাড়া।
খটাখট আওয়াজ তুলে যে তাঁতিপাড়া দিনভর ব্যস্ত থাকত, এখন সেখানে শুধুই দীর্ঘশ্বাস। ছবিটা একই রকম তাঁতের হাটেও। সেখানে ক্রেতাদের ভিড় ক্রমেই পাতলা হচ্ছে। পসরা সাজিয়ে মনমরা হয়ে বসে আছেন ব্যবসায়ীরা।
তাঁতযন্ত্রের সুতো ঠিক করতে করতে শান্তিপুরের আনসার শেখ বলছেন, ‘‘আচমকা কী সব ঘটে গেল বলুন তো! এমনটা চলতে থাকলে তো আমাদের বেঁচে থাকাই কঠিন হয়ে পড়বে।’’ আর মালঞ্চের আলাউদ্দিন শেখ বলছেন, ‘‘মাকুটা চলে বলেই তো জীবনটা চলে। সেটাই যদি থমকে যায়, তাহলে খাব কী?’’
রুগ্ণ শরীর। সেই কিশোর বয়স থেকে তাঁত চালাচ্ছেন আলাউদ্দিন। বয়সের ভারে শরীরটা সামনের দিকে ঝুঁকে পড়েছে। আপন মনেই ওই বৃদ্ধ বিড়বিড় করছেন, ‘‘খারাপ সময় এর আগেও দেখেছি। কিন্তু এমনটা কখনও হয়নি।’’
শুধু শান্তিপুর নয়, নোট বাতিলের গেরোয় বিপাকে পড়েছে নদিয়ার বহু তাঁত শিল্পী ও ব্যবসায়ীরা। ধাক্কা সামলাতে হিমসিম খাচ্ছেন মহাজনেরাও। বাজারে নগদ টাকার ঘাটতি রয়েছে। এই সময়ে চাহিদাও তলানিতে। এক ধাক্কায় ব্যবসা নেমে এসেছে প্রায় তিন ভাগের এক ভাগ। আগামী দশ দিনের মধ্যে পরিস্থিতির কোনও পরিবর্তন না হলে পরিণতি ভয়ঙ্কর হবে বলে মনে করছেন ব্যবসায়ীরা। মহাজন, শিল্পী, ব্যবসায়ীদের বাইরেও সুতো রং করা, বুটি কাটা, কাপড় মাড় দেওয়ার সঙ্গেও জড়িয়ে আছেন কয়েক হাজার মানুষ। একই সমস্যায় পড়েছেন তাঁরাও।
সরকারি হিসেবে এই মুহূর্তে ফুলিয়া, শান্তিপুর, নবদ্বীপ, রানাঘাট, করিমপুর-সহ গোটা নদিয়া জেলায় তাঁতের সংখ্যা প্রায় ১ লক্ষ ১২ হাজার। ব্যবসায়ীদের দাবি, বাস্তবে সেই সংখ্যাটা অনেক বেশি। শুধু শান্তিপুরের তিনটি কাপড়ের হাটে এই সময়ে দিনে তিন থেকে সাড়ে তিন কোটি টাকার বিকিকিনি চলে। এই মুহূর্তে তা নেমে দাঁড়িয়েছে প্রায় এক কোটিতে।
শান্তিপুরের একটি হাটের মালিক বিভাস ঘোষ জানান, বাজারের অবস্থা খুবই খারাপ। বেচাকেনা একেবারেই পড়ে গিয়েছে। ব্যবসায়ীদের হাতে টাকা নেই। তাঁরা কাপড় কিনবেন কী দিয়ে। তিনি বলছেন, “আসলে আমাদের কারবারটাই চলে নগদ টাকায়। আর সেই নগদে টান পড়ায় তার প্রভাব পড়েছে বাজারেও।”
শান্তিপুরের হাটগুলিতে ফুলিয়া ও শান্তিপুর ছাড়াও ধনেখালি, নবদ্বীপ, ধুবুলিয়া, সুমুদ্রগড় ও ধাত্রীগ্রামের তাঁতিরাও আসেন। সারা দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে ছোট-বড় ব্যবসায়ীরা আসেন কাপড় কিনতে। মধ্যরাত থেকে শুরু হয় বেচাকেনা। সকাল হওয়ার আগেই সব ফাঁকা। সেই চেনা ছবিটা বদলে গিয়েছে ৮ নভেম্বরের পর থেকে।
পাঁচশো ও এক হাজার টাকার নোট বাতিল হয়ে যাওয়ায় নিয়ম করে হাট বসছে ঠিকই। কিন্তু দেখা নেই ক্রেতাদের। যে দু’একজন আসছেন তাঁরা পুরনো নোট দিয়েই কাপড় কিনতে চাইছেন। কেউ কেউ আবার চাহিদা না থাকার সুযোগ নিয়ে দামও হাঁকছেন অনেক কম। সব মিলিয়ে আতান্তরে তাঁতিরা।
এ দিকে গুদামে ডাঁই হয়ে পড়ে রয়েছে কাপড়। কবে সে সবের গতি হবে কেউ জানেন না। শান্তিপুর তাঁত ব্যবসায়ী সমিতির সম্পাদক তারক দাস বলছেন, “ব্যবসার অবস্থা এত খারাপ কোনও দিন হয়নি। বড় বড় ব্যবসায়ীরা কাপড় কেনা প্রায় বন্ধই করে দিয়েছেন। হাতে নগদ টাকা না থাকায় মহাজনেরা তাঁতিদের মজুরিও দিতে পারছেন না।’’
পরিস্থিতি ঠিক কতটা খারাপ তা বোঝাতে ফুলিয়ার তাঁতশিল্পী অভিনব বসাক বলছেন, “আমাদের জন্য প্রায় ১২০০ শ্রমিক তাঁত বোনেন। তাঁরা মূলত জামদানি ও টাঙ্গাইল তৈরিতেই দড়। মজুরি গড়ে প্রায় সাড়ে চারশো টাকা। যা পরিস্থিতি সেই মজুরিটুকুও দিতে গিয়ে হিমশিম খেতে হচ্ছে।” অভিনব জানাচ্ছেন, তাঁদের কাউন্টার থেকে দিনে গড়ে আড়াই লক্ষ টাকার কাপড় ও সুতো বেচাকেনা হয়। এখন সেটা কমে দাঁড়িয়েছে সাকুল্যে চোদ্দো থেকে পনেরো হাজার টাকায়।
এমন পরিস্থিতির কথা কবুল করছেন শান্তিপুরের হস্ততাঁত উন্নয়ন দফতরের আধিকারিক দেবাশিস বন্দ্যোপাধ্যায়। তিনি বলেন, “টাকার অভাবে শিল্পটাই ভেঙে পড়ার মুখে। কাপড়ের বিক্রি নেই। তাঁতিরা মজুরি পাচ্ছেন না। পরিস্থিতি ক্রমশ খারাপ হচ্ছে। বিষয়টি জানিয়ে আমরা কেন্দ্রীয় সরকারকে রিপোর্ট পাঠিয়েছি।”
সেই রিপোর্টের উত্তর কী আসবে তা জানেন না শান্তিপুরের মূলচাঁদ শেখ। ঘরে যেটুকু সুতো রয়েছে তা দিয়েই রাত জেগে তাঁতযন্ত্রের সামনে বসে থাকছেন বছর সত্তরের ওই বৃদ্ধ। মাঝেমধ্যে খটাখট আওয়াজ উঠছে ঠিকই। কিন্তু নোটের আকালে সে আওয়াজও যেন চেনা ছন্দ হারিয়ে ফেলেছে।