শুকিয়ে কাঠ পুকুর। অণ্ডালের কাজোড়ায়। ছবি: ওমপ্রকাশ সিংহ
জলের সন্ধানে পাইপে ফুটো করতে হয় কাউকে। কেউ আবার অজয়ের বালি খুঁড়ে জলের হদিস পেতে চান। আসানসোলের চন্দন কোড়া ও গোঁসাই মাহালিদের অবস্থা সুকুমার রায়ের ‘অবাক জলপান’-এর সেই তৃষ্ণার্ত পথিকের মতোই। রানিগঞ্জ, জামুড়িয়া পাণ্ডবেশ্বরে জলের আকালের কথা উঠলেই তাঁরাও সেই পথিকের মতোই প্রশ্ন করছেন, ‘‘একটু জল পাই কোথায় বলতে পারেন!’’
জলের দাবিতে বিক্ষোভ এ বঙ্গে নতুন নয়। তেষ্টা মেটাতে পশ্চিম বর্ধমানের খনি এলাকার মানুষকেও একই পথ ধরতে হয়। আসানসোল (দক্ষিণ) বিধানসভা কেন্দ্রের রানিগঞ্জ গ্রামীণ এলাকার বল্লভপুরের একাংশে জল-সমস্যা সমাধানের দাবিতে বহু বার রাস্তা অবরোধ করেছেন সেখানকার বাসিন্দারা। পাণ্ডবেশ্বরের কেন্দ্রা ও বৈদ্যনাথপুর, কেন্দ্রা পঞ্চায়েত এলাকায় জলের সমস্যা আরও তীব্র। বৈদ্যনাথপুরের মিলন বাদ্যকরের অভিযোগ, ‘‘জনস্বাস্থ্য ও কারিগরি দফতরের বসানো কল থেকে পর্যাপ্ত জল মেলে না।’’ ভরসা বলতে রয়েছে কুয়ো আর পুকুর।
তৃণমূল পরিচালিত কেন্দ্রা পঞ্চায়েতের তৃণমূল সদস্য লোকমান আনসারি জানান, ডালুরবাঁধ বাঙালপাড়া, ৮ নম্বর মুসলিমপাড়ার বেশির ভাগ এলাকায় কল নেই। কেন্দ্রা গ্রাম, ছাতাধাওড়া-সহ বিস্তীর্ণ এলাকায় যে জল যায়, তা পানের অযোগ্য। ফলে, দূরে কোথাও গিয়ে বা নদীর বালি খুঁড়ে জল সংগ্রহ করতে হয় বাসিন্দাদের। কেন্দ্রায় অজয় নদের ধারে জনস্বাস্থ্য ও কারিগরি দফতর নতুন জলপ্রকল্প করলেও সরবরাহ শুরু হয়নি।
জামুড়িয়ার চুরুলিয়া পঞ্চায়েতের দেশেরমহান গ্রাম ও সংলগ্ন এলাকার বাসিন্দাদের দাবি, অজয় নদের ধারে তালডাঙা জলপ্রকল্প থেকে অনিয়মিত ভাবে জল সরবরাহ করা হয়। তাঁদের অভিযোগ, ‘‘এখন নদী থেকেও জল আনা যাচ্ছে না। কারণ, অবৈধ ভাবে বালি তুলে নেওয়ায় জলের স্তর তলানিতে ঠেকেছে।’’
জামুড়িয়ায় অজয় নদের ধারে দরবারডাঙায় ২০০৯ সালে নতুন জলপ্রকল্প তৈরি হয়েছিল। জামুড়িয়া পুর-এলাকার অর্ধেকের বেশি অংশে জল সরবরাহ করা হয়েছিল। বাকি এলাকায় সম্বল ইসিএলের পাইপ লাইন কিংবা জলাশয়। আসানসোল পুরসভার ৩ নম্বর ওয়ার্ডের ১০ নম্বর বাঁকশিমুলিয়া কলোনির তিনপুকুরিয়া, মাঝিপাড়া, শিশুমহল্লায়, ২ নম্বর ওয়ার্ডের শিবপুর, ৮ নম্বর ওয়ার্ডের কলোনিপাড়া, কুমারপাড়ায় জলের পাইপে চাপ কম থাকায় জল আসে না বলে অভিযোগ।
পাণ্ডবেশ্বরের বাঙালপাড়ায় কলে জল পড়ছে না। ছবি: ওমপ্রকাশ সিংহ
রানিগঞ্জ বিধানসভা কেন্দ্রের কাজোড়া পঞ্চায়েত এলাকায় জনস্বাস্থ্য ও কারিগরি দফতর জল সরবরাহের ব্যবস্থা করেছিল বহু আগে। কিন্তু গত ১০ বছরের বেশি সময় জল ধরে পাইপে জল আসে না বলে জানাচ্ছেন তৃণমূল পরিচালিত ওই পঞ্চায়েতের সদস্য মলয় চক্রবর্তী। অগত্যা, সেখানকার বাসিন্দাদের ভরসা সেই কুয়ো, টিউবওয়েল আর জলাশয়। তেমনই উখড়া পঞ্চায়েতের সারদাপল্লি, হনুমানডাঙার বাসিন্দাদের দাবি, পাইপ লাইন থেকে জল পড়ছে না গত সাত বছর। সম্প্রতি জলের দাবিতে উখড়া-হরিপুর রাস্তা অবরোধ করেন বাসিন্দারা। রানিগঞ্জে ৩৩ ও ৩৪ নম্বর ওয়ার্ডের আমরাসোতা ও সিহারশোলে জলের লাইনে চাপ কম। ফলে, জল পর্যাপ্ত মেলে না। ৩৭ নম্বর ওয়ার্ডের দামোদা কোলিয়ারি এবং ২ ও ৬ নম্বর এলাকায় পাইপ লাইন নেই। বাবুপুরে আবার পাইপ পাতা হলেও, তা থেকে জল পড়ে না। ৩৬ নম্বর ওয়ার্ডের সুকান্তপল্লিতেও পর্যাপ্ত জল পৌঁছয় না বলে অভিযোগ।
ভোট এসেছে। শুরু হয়েছে জল-সমস্যা নিয়ে রাজনৈতিক দলগুলির মধ্যে চাপান-উতোর। জামুড়িয়ার সিপিএম প্রার্থী ঐশী ঘোষ ও বিজেপি প্রার্থী তাপস রায়, রানিগঞ্জের সিপিএম প্রার্থী হেমন্ত প্রভাকর ও বিজেপি প্রার্থী বিজন মুখোপাধ্যায় জানান, বেশির ভাগ এলাকা থেকে জলকষ্টের অভিযোগ উঠে আসছে। জল-সমস্যা মেটানাকে অগ্রাধিকার দেওয়ার আবেদন জানাচ্ছেন বাসিন্দারা।
জামুড়িয়া ও রানিগঞ্জের তৃণমূল প্রার্থী যথাক্রমে হরেরাম সিংহ ও তাপস বন্দ্যোপাধ্যায়ের দাবি, ‘‘বামফ্রন্টের ৩৪ বছর শাসনকালে জলের সমস্যা তীব্র হয়েছিল। আমরা ক্ষমতায় আসার পরে, অনেকটা মিটেছে। বাকিটা মেটানোর জন্য রাজ্য সরকার একাধিক প্রকল্প নিয়েছে।’’ হরেরামবাবু জানান, জামুড়িয়ায় অজয় নদের ধারে দরবারডাঙার জলপ্রকল্প সম্প্রসারণের কাজ প্রায় শেষের মুখে। নিবার্চন মিটলে, জলের সংযোগ দেওয়া হবে।
পাণ্ডবেশ্বরে বিজেপি প্রার্থী জিতেন্দ্র তেওয়ারির অভিযোগ, ‘‘কেন্দ্র সরকার খনি এলাকায় জল-সমস্যা মেটাতে যে অর্থ বরাদ্দ করে, রাজ্য সরকার তার অর্ধেকও খরচ করেনি। তাতেই এই অবস্থা হয়েছে। কেন্দ্রায় জলপ্রকল্প নির্মাণের সঙ্গে যুক্ত ঠিকাদারের থেকে পাণ্ডবেশ্বরের তৃণমূল প্রার্থী নরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তীর অনুগামীরা ঠিকাদারের কাছে কর্মী নিয়োগ থেকে শুরু করে নানা অযৌক্তিক দাবি করেছিলেন। সে সব সমস্যার জন্য পাইপ পাতার কাজ শেষ করতে দেরি হয়েছে।’’
অভিযোগ উড়িয়ে নরেন্দ্রনাথবাবুর পাল্টা দাবি, ‘‘জিতেন্দ্রবাবু দিশেহারা হয়ে ভুল বকছেন।’’