মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে চিঠি লিখে রাস্তা ফেরত চেয়েছিলেন উপাচার্য বিদ্যুৎ চক্রবর্তী। —নিজস্ব চিত্র।
উপাসনাগৃহ থেকে কালীসায়র মোড় পর্যন্ত সেই বিতর্কিত রাস্তা রাজ্য সরকারের কাছে ফেরত চেয়েছেন বিশ্বভারতী কর্তৃপক্ষ। উপাচার্য বিদ্যুৎ চক্রবর্তীই মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে চিঠি লিখে রাজ্যের পূর্ত দফতরের অধীনে থাকা ওই রাস্তাটি ফেরত চেয়েছেন। কিন্তু রাজ্য সরকার এখনও কোনও সাড়া দেয়নি, এই দাবি তুলে এ ব্যাপারে রাষ্ট্রপতি দ্রৌপদী মুর্মুর হস্তক্ষেপ চাইলেন উপাচার্য। চিঠির প্রতিলিপি দেওয়া হয়েছে রাজ্যপাল সিভি আনন্দ বোস এবং কেন্দ্রীয় শিক্ষামন্ত্রী ধর্মেন্দ্র প্রধানকেও।
সম্প্রতি শান্তিনিকেতনকে বিশ্ব হেরিটেজ তকমা দিয়েছে ইউনেস্কো। এর পরেই মুখ্যমন্ত্রীকে চিঠি লিখে উপাসনাগৃহ থেকে কালীসায়র মোড় পর্যন্ত রাস্তা ফেরত চান উপাচার্য। চিঠিতে বিদ্যুৎ জানান, ওই রাস্তার দুই ধারে একাধিক ঐতিহ্যবাহী ভবন, স্থাপত্য, ভাস্কর্য আছে। ভারী যান চলাচলের ফলে কম্পনে সেগুলি ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে। ইউনেস্কোর তকমা ধরে রাখতে ওই রাস্তাটি যাতে সঠিক ভাবে রক্ষণাবেক্ষণ করা যায়, তার জন্য সেটি বিশ্বভারতীকে আবার ফিরিয়ে দেওয়া হোক। এ বার রাস্তা ফেরত পাওয়া নিয়ে রাষ্ট্রপতিকে চিঠি দিলেন বিদ্যুৎ। জানালেন, মুখ্যমন্ত্রী তাঁর চিঠির কোনও জবাব দেননি। তাই রাষ্ট্রপতির হস্তক্ষেপ চাইছেন তিনি।
দ্রৌপদীকে লেখা চিঠিতে উপাচার্য লিখেছেন, ‘‘সম্প্রতি শান্তিনিকেতনকে বিশ্ব হেরিটেজ স্বীকৃতি দিয়েছে ইউনেস্কো। তাই বিশ্বভারতীকে রক্ষা করা আমাদের কর্তব্য। শান্তিনিকেতন থেকে শ্রীনিকেতনের সংযোগকারী প্রায় তিন কিলোমিটার ওই রাস্তাটিতে ভারী জিনিসপত্র বহনকারী গা়ড়ি চলতে দেওয়া হলে কম্পনে ১০০ বছরের বেশি পুরনো ভবনগুলি ক্ষতিগ্রস্ত হবে। পূর্বে রাস্তাটি বিশ্বভারতীর অধীনে ছিল। আবারও বিশ্বভারতীকেই ঐতিহ্যবাহী ভবনগুলির রক্ষার্থে রাস্তা ফিরিয়ে দেওয়া হোক। টোটো এবং ভারী যান চলাচলে আশ্রমিক পরিবেশে সমস্যা বাড়ছে। রাস্তার দু’পাশ অবৈধ টোটোর স্ট্যান্ডে পরিণত হয়েছে। যা সাধারণ মানুষ থেকে পর্যটকদের বিড়ম্বনায় ফেলছে। এ ছাড়াও বিভিন্ন ফেরিওয়ালা অস্থায়ী দোকান তৈরি করে পরিবেশকে কলুষিত করছেন। বিশ্বের ঐতিহ্যবাহী স্থান হিসেবে শান্তিনিকেতনকে রক্ষা করার দায়িত্ব সকলের। সকলকেই এগিয়ে আসা উচিত।’’
২০১৭ সালে বিশ্বভারতীর তৎকালীন ভারপ্রাপ্ত উপাচার্য স্বপন দত্তের আবেদনের ভিত্তিতে শান্তিনিকেতন থেকে শ্রীনিকেতন সংযোগকারী প্রায় তিন কিলোমিটার ওই রাস্তাটির তত্ত্বাবধানের দায়িত্ব বিশ্বভারতীর হাতে তুলে দিয়েছিল রাজ্য সরকার। অমর্ত্য সেন, ক্ষিতিমোহন সেন, নন্দলাল বসু, গৌরী ভঞ্জ, শান্তিদেব ঘোষ-সহ বহু বিশিষ্ট আশ্রমিকের বাসভবন এই রাস্তার ধারেই। পরে আশ্রমিকদের একাংশ অভিযোগ তোলেন, বিদ্যুতের সময়ে যখন তখন ওই রাস্তা বন্ধ করে দেওয়া থেকে শুরু করে সমস্ত রকম মালবাহী গাড়ির প্রবেশ নিষিদ্ধ করায় তাঁরা অসুবিধার মুখে পড়েছেন। শুধু তা-ই নয়, সাপ্তাহিক মন্দির বা বিশেষ উপাসনার দিনগুলিতেও শিক্ষাভবন মোড় থেকেই সমস্ত ধরনের যান চলাচল আটকে দেওয়া হত বলেও অভিযোগ আশ্রমিকদের। একই সঙ্গে ওই রাস্তায় সংবাদমাধ্যমের প্রবেশ বা ছবি তোলাও ক্ষেত্রবিশেষে নিষিদ্ধ করে দেওয়া হয়। আশ্রমিকদের পক্ষ থেকে এ নিয়ে চিঠি দেওয়া হয় মুখ্যমন্ত্রীকে। এর পরেই ২০২০ সালে রাস্তাটি ফিরিয়ে নেওয়ার ঘোষণা করেন মমতা। পূর্ত দফতরের (সড়ক) তরফে রাস্তার ধারে লাগানো হয় স্থায়ী হোর্ডিং। সেখানে লেখা, রাস্তার রক্ষণাবেক্ষণের দায়িত্বে এখন পূর্ত দফতর। ইউনেস্কোর স্বীকৃতিকে কাজে লাগিয়ে এখন সেই রাস্তাই ফেরত পেতে চাইছে বিশ্বভারতী।
বিশ্বভারতীর পড়ুয়া ও অধ্যাপকদের একটি অংশের মতে, ইউনেস্কোর ঘোষণা নিয়ে উচ্ছ্বাস প্রকাশ করেছিলেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা। বোলপুরে মিছিলও করেছে শাসকদল। সেই সুযোগকেই কাজে লাগাতে চাইছেন উপাচার্য। এক অধ্যাপকের কথায়, ‘‘মুখ্যমন্ত্রী তাঁর খুশি ব্যক্ত করেছেন এই হেরিটেজ ঘোষণায়। এ বার রাস্তা ফেরতের আবেদনের মধ্যে দিয়ে মুখ্যমন্ত্রী আদৌ কতটা আন্তরিক শান্তিনিকেতনের প্রতি, তা বেআব্রু করারই কৌশল নিয়েছেন উপাচার্য। রাস্তা ফেরত দিলে বিশ্বভারতীরই ভাল। না দিলে মুখ্যমন্ত্রীকে দোষারোপে সুবিধা হবে।’’