সন্দেশখালিতে মহিলাদের প্রতিবাদ। — ফাইল চিত্র।
একেই কি বলে দাসতন্ত্র?
“হাড় ভাঙা খাটনির পরে একটা টাকা তো দূর, সামান্য খাবারটুকুও দিত না। চাইলে দূর দূর করে তাড়িয়ে দিত। এক বার আমরা দু’-তিন জন মিলে একটু জোর দিয়ে বলার চেষ্টা করেছিলাম। আমাদের ধাক্কা মেরে ফেলে দিয়েছিল শিবুর (সর্দার) লোকেরা। বলেছিল, ‘কোদালের বাট দিয়ে মেরে তোদের বরগুলোকে খতম করব, যদি আর এক বারও এই সাহস দেখাস।’ সাহস তো দূর, আমাদের চোখ তুলে তাকানোর ক্ষমতাও ছিল না।’’ কথা বলার সময়ে বছর পঁচিশের মেয়েটির চোখে যেন আগুন ঝরছিল।
“১০০ দিনের কাজ করে যে টাকা পেতাম, ব্যাঙ্কে রাখতাম। সেই টাকাও ওদের হাতে তুলে দিতে হত। সেই টাকায় মদ খেত ওরা। বলত, ‘তোরা যে বেঁচে আছিস, সেই তো ঢের। আবার টাকা কেন লাগবে?’ নিজেদের জীবনের ওপরেই ঘেন্না ধরে গিয়েছিল আমাদের,” বলছিলেন পারুল কয়াল।
সন্দেশখালি।
ঘরে ঘরে মহিলাদের সঙ্গে কথা বলে যা উঠে এসেছে, তাকে দাসপ্রথার সঙ্গে তুলনা করলে কোনও ভাবেই অতিরঞ্জন হয় না। দিনের পর দিন যে ভাবে বিভিন্ন বয়সের মহিলাদের জবরদস্তি ডেকে এনে খাটতে বাধ্য করা হয়েছে, এক টাকা পারিশ্রমিক তো দূরের কথা, নিজেদের সঞ্চিত অর্থ, ১০০ দিনের কাজের টাকা, এমনকি লক্ষ্মীর ভান্ডারের অনুদানও যে ভাবে কেড়ে নেওয়া হয়েছে, তা দাসপ্রথার থেকে কম কি?
কিন্তু এ বার ছবিটা বদলাচ্ছে। নিজেদের ভাগ্য নিজেরাই লিখতে চলেছেন সন্দেশখালির মেয়েরা। পাত্র পাড়া, কলোনি পাড়া, পুকুর পাড়া, নস্কর পাড়ার ঘরে ঘরে ঝাঁটা, লাঠি, বঁটি, কাটারি, দা, বাঁশ— যে যা পেরেছেন মজুত করেছেন। কয়ালপাড়ার এক মহিলা যখন সে সব দেখাচ্ছিলেন, প্রশ্ন করলাম, এখনও এ সবের প্রয়োজন পড়তে পারে বলে মনে হয়? জবাব এল, “মাথারা জেলে। কিন্তু ওই নোংরা স্বভাব আরও যাদের মধ্যে ওরা ঢুকিয়েছে, তারা তো বাইরে। শোরগোল কমে এলে পুলিশ তো আবার চোখে-কানে কাপড় বেঁধে রাখবে। তাই নিজেদের ব্যবস্থা নিজেদেরই করতে হবে।”
পুলিশ-প্রশাসনের উপর এতটা ভরসা হারালেন কী ভাবে? এক নির্যাতিতা বললেন, “যে ঘরে রাতের পর রাত আমাদের ওপর জুলুম চলত, থানা তার থেকে বড় জোর দেড়শো মিটার দূরে। পাশেই বিডিও অফিস। সবাই সব জানত। এমনও রাত গেছে যখন আমাদের অনেকে চিৎকার করেছে, কেঁদেছে, আর তা শুনে শিবু-উত্তম আর দলবল গলা ফাটিয়ে হেসেছে। এগুলো কারুর কানে যেত না ভেবেছেন? তিন জন ধরা পড়েছে, বাকিরা বাইরে। আর পুলিশও রাতারাতি তাদের চরিত্র বদলাবে না। তাই আমরাও তৈরি থাকছি। যে হাতে ওরা জোর করে খুন্তি ধরাত, সেই হাত দিয়েই এবার খুন্তির ছ্যাঁকা দেব।”
এক তরুণী বললেন, “আমাদের ডেকে পাঠিয়ে রান্নাবান্না করে খাইয়ে সকলকে খুশি করতে বলা হত। কখনও মাংস, কখনও বিরিয়ানি, কখনও পিঠে। এক-এক দিন এক-এক রকম ফরমায়েশ। কখনও কখনও সেই আড্ডায় পুলিশের লোকজনও থাকত। আমাদের বলা হত, বাবুদের যত্নআত্তি কর, খুশি কর, তা না হলে তোদের বর, ছেলেদের হাজতে ঢোকাবে। এ জন্মে আর বেরোতে পারবে না, এমন সব কেস দেবে। আমরা এগুলো শুনে ভয়ে সিঁটিয়ে থাকতাম।”
রাতবিরেতে অফিসে ডেকে নিয়ে শুধু রান্না করতে বলা হত? কর্ণখালি ৮ নম্বরের রাস্তায় দাঁড়িয়ে এক তরুণী বললেন, “এই প্রশ্ন অনেকেই করছেন। শুধুই রান্না? যেন শুধু রান্না করালে অপরাধটা কমে যায়! কতগুলো মাতাল আপনার সামনে বসে মদ খেয়ে চলেছে আর আপনার দিকে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। আপনার কেমন লাগবে? ভয় করবে না? ঘেন্না করবে না? বছরের পর বছর আমাদের রাতগুলো এ ভাবে কাটত। আমরা যেন ওদের সম্পত্তি। আমাদের নিয়ে যেন যা খুশি করা যায়!”
কয়াল পাড়ার কমলা দে কয়ালের আনাজের দোকান। আর উমা কয়ালের মুদির দোকান। সারা রাত তাঁদের অফিসে ডেকে নিয়ে গিয়ে বসিয়ে রাখা হত। আর সকাল হলে বলা হত, ‘দোকানে যা। একটু পরেই দোকান থেকে মাল নিতে আসব।’ ওঁরা দোকানে ঠায় বসে থাকতেন। নেতারা দলবল নিয়ে দোকানে আসত বিকেল নাগাদ। এসে যা খুশি জিনিসপত্র উঠিয়ে নিয়ে যেত। দাম দেওয়ার প্রশ্নই নেই। তার পরে রাতে আবার ডাক পড়ত। ওঁরা বললেন, “ঘুমে গোটা শরীর ভেঙে আসত। কিন্তু ঘুমোনো যাবে না। কড়া নির্দেশ। এ যে কী ধরনের অত্যাচার, তা যে না সহ্য করেছে সে বুঝবে না।”
শুধু শাহজাহান, উত্তম সর্দার, শিবু হাজরা নয়। এমন আরও একাধিক নাম ক্রমশ প্রকাশ্যে আসছে। লড়াইটা তাই এখনই থামবে না বলে দাবি করছেন এখানকার মহিলারা।
কিন্তু কত দিন? সন্দেশখালি অধ্যায়ও কি সময়ের সঙ্গে ক্রমশ ফিকে হবে? নাকি ভবিষ্যতেও ক্ষমতাবানের অত্যাচারের বিরুদ্ধে সাধারণের রুখে দাঁড়ানোর ‘মডেল’ হয়ে থাকবে?