ভারতীয় পড়ুয়াদের প্রিয় গন্তব্য ইউক্রেন। গ্রাফিক: শৌভিক দেবনাথ
ইউক্রেন। এখন এক যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশ। তবে চিকিৎসক হতে চাওয়া ভারতীয়দের কাছে আরও এক পরিচয় রয়েছে পূর্ব ইউরোপের এই দেশের। ডাক্তারি পড়ার মহাতীর্থ। এই যুদ্ধ জানিয়ে দিল হাজারে হাজারে ভারতীয় পড়ুয়া রয়েছেন সে দেশে। যাঁদের বেশির ভাগই গিয়েছেন চিকিৎসাশাস্ত্র নিয়ে পড়াশোনা করতে। এখনও পর্যন্ত যা হিসেব পাওয়া গিয়েছে এমন বাঙালি পড়ুয়ার সংখ্যাও সাড়ে তিনশোর আশপাশে। কিন্তু কেন এত পড়ুয়া দলে দলে ইউক্রেনে যান ডাক্তারি পড়তে? কোন টানে ইউরোপে পাড়ি জমান তাঁরা? অভিভাবকরাই বা কেন সুদূর বিভুঁইয়ে পাঠান ছেলেমেয়েদের? ইউক্রেনে সন্তানদের পড়তে পাঠানো অভিভাবক থেকে পাশ করে ফিরে আসা কলকাতার চিকিৎসকের সঙ্গে কথা বলে জানল আনন্দবাজার অনলাইন।
বীরভূমের মুরারইয়ের বাসিন্দা নাজিয়া রহমান ছোট থেকেই চিকিৎসক হওয়ার স্বপ্ন দেখেছিলেন। কিন্তু দেশের কোথাও ভর্তি হওয়ার সুযোগ পাননি। অগত্যা চলে যান ইউক্রেন। তৃতীয় বর্ষের ছাত্রী নাজিয়া এখন হাঙ্গেরিতে। ইউক্রেন সীমান্ত পার হতে পেরেছেন। এখন দেশে ফেরার অপেক্ষায়। কথা হল নাজিয়ার বাবা গোলাম মুজিবরের সঙ্গে। তিনি বললেন, ‘‘ক’টা দিন খুব উদ্বেগে ছিলাম। এখন কিছুটা নিশ্চিন্ত।’’ কিন্তু মেয়েকে কেন ইউক্রেনে পড়তে পাঠিয়েছিলেন? মুজিবর বললেন, ‘‘এখানে কোনও সরকারি মেডিক্যাল কলেজে সুযোগ পায়নি। কিন্তু মেয়ের খুব জেদ ছিল চিকিৎসক হবেই। এখানে কয়েকটা বেসরকারি মেডিক্যাল কলেজে চেষ্টা করেছিলাম। কিন্তু কোর্সের খরচ আর ক্যাপিটেশন ফি মিলিয়ে খরচ প্রায় কোটি টাকার কাছাকাছি। তাই অনেকটা কম খরচে ইউক্রেনে পাঠিয়ে দিই।’’ কৃষক মুজিবর জানিয়েছেন, পাঁচ বছর আট মাসের কোর্সের জন্য ইউক্রেনের মেডিক্যাল কলেজে খরচ পড়েছে ২৬ লাখ টাকার মতো।
প্রায় কাছাকাছি বক্তব্য, বীরভূমেরই বাসিন্দা আফতাবউদ্দিনের। তাঁর ছেলে শাহরুখ সুলতান আহমেদ ইতিমধ্যেই রোমানিয়ায় পৌঁছেছেন। বাবা আফতাবউদ্দিন আশা করছেন দু’এক দিনের মধ্যেই ছেলে বাড়ি ফিরে আসবে। বললেন, ‘‘রাজ্যে তো বটেই, দেশের সর্বত্রই ডাক্তারি পড়ানোর জন্য চেষ্টা করেছিলাম। কিন্ত খরচ সামলাতে পারব না বুঝেই ইউক্রেনে পাঠিয়েছি। ওখানে খরচ অর্ধেকের থেকেও অনেক কম। আর ইউক্রেন থেকে পাশ করলে ইউরোপের অন্যান্য দেশে উচ্চশিক্ষা থেকে চাকরি সবেরই সুযোগ বেশি।’’
অভিভাবকদের সঙ্গে কথা বলে যা শোনা গেল তারই প্রতিধ্বনি ইউক্রেন থেকে ডাক্তারি পাশ করা কলকাতার চিকিৎসক সৌরভ দে-র কথায়। তিনি বলেন, ‘‘খরচ কম তো বটেই। সেই সঙ্গে ইউক্রেন লেখাপড়ার মানও খুব ভাল। আর রাশিয়া, জার্মানি-সহ ইউরোপের বিভিন্ন দেশে আরও পড়াশোনা করা কিংবা প্র্যাকটিস করার সুবিধা রয়েছে। ইউক্রেনের মেডিক্যাল কলেজগুলি খুবই ভাল এবং সেগুলির ডিগ্রির গুরুত্বও রয়েছে। তবে ভারতে ইউক্রেনের ডিগ্রি নিয়ে চিকিৎসা করা যায় না। তার জন্য ভারতীয় মেডিক্যাল কাউন্সিলের নেওয়া ‘ফরেন মেডিক্যাল গ্র্যাজুয়েট একজাম’ (এফএমজিই) পাশ করতে হয়।’’ টের্নোপিল ন্যাশনাল মেডিক্যাল কলেজের প্রাক্তনী সৌরভ ইউক্রেন থেকে ফিরে সেই পরীক্ষায় পাশ করেছেন। তবে অনেকেই তা পারেন না। ওই পরীক্ষায় পাশের হার খুবই কম। এতটাই যে না পারার সংখ্যাটাই বেশি।
হাঙ্গেরিতে ইউক্রেনে পড়তে যাওয়া ভারতীয়রা। রয়টার্স।
পাঁচ বছর আগে ইউক্রেন থেকে ফিরলেও এখনও এফএমজিই পাশ করতে পারেননি ইউরোপের এমবিবিএস ডিগ্রিধারী সুগত চৌধুরী জানান, ‘‘পারিবারিক কারণে আমার পক্ষে বিদেশে চাকরি করতে যাওয়া সম্ভব নয়। তাই এমবিবিএস ডিগ্রি থাকলেও চিকিৎসক হতে পারিনি। চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছি। আপাতত পারিবারিক ওষুধের ব্যবসা দেখাশোনা করি।’’ ইউক্রেন থেকে পাশ করেও চিকিৎসা পেশায় ঢুকতে না পারলেও সে দেশের মেডিক্যাল কলেজে পড়ার সুযোগ সুবিধা নিয়ে কথা বলায় খুবই উৎসাহী সুগত। কিভ মেডিক্যাল কলেজের প্রাক্তনী বলেন, ‘‘শুধু ভারত নয়, বিশ্বের বিভিন্ন দেশ থেকে ছেলেমেয়েরা ডাক্তারি পড়তে আসে ইউক্রেনে। আমেরিকা-সহ ৪৫টা দেশের সহপাঠী পেয়েছি আমি। শুধু লেখাপড়ার খরচই নয়, থাকা-খাওয়াও অনেকটাই সস্তা। আর ওখানে ভারতীয় রেস্তরাঁও রয়েছে। ফলে অনেক সুবিধা।’’
বিদেশে পড়তে যাওয়ার জন্য পড়ুয়াদের শিক্ষাঋণ প্রদানকারী এক সর্বভারতীয় সংস্থার কলকাতা শাখার এক কর্তা জানান, শুধু বাংলা নয়, ভারতের অনেক জায়গা থেকেই ইউক্রেনে পড়তে যান ছেলেমেয়েরা। মোট ৩৩টি মেডিক্যাল কলেজ রয়েছে। এগুলিতে ফি বাবদ বছরে খরচ মোটামুটি সাড়ে তিন লাখ টাকার মতো। ফলে ছ’বছরের ফি বাবদ খরচ ২০ লাখ টাকার মতো। সেখানে ভারতের বেসরকারি মেডিক্যাল কলেজগুলিতে কোটি টাকার কাছাকাছি পৌঁছে যায় মোট খরচ।
ভারতে মোট মেডিক্যাল কলেজ ৫২৯টি। এর মধ্যে সরকারি ২৬৯টি। বাকি ২৬০টি বেসরকারি। সব মিলিয়ে মেডিক্যালের আসন সংখ্যা ৮৮,১২০টি। কিন্তু সেই তুলনায় দেশে ডাক্তারি পড়তে আগ্রহী পড়ুয়ার সংখ্যা অনেক বেশি। আর তাতেই বিদেশে পাড়ি জমানো পড়ুয়ার সংখ্যা বাড়ছে দিন দিন। এখন ইউক্রেনের কথা বেশি করে জানা গেলেও তুলনায় অনেক বেশি পড়ুয়া ভারত থেকে চিন এবং ফিলিপিন্সে ডাক্তারি পড়তে যান। ফি বছর দেশে লক্ষ লক্ষ ছাত্রছাত্রী ডাক্তারি পড়ার প্রবেশিকা এনইইটি পরীক্ষায় বসেন। কিন্তু পাশ করেও র্যাঙ্ক ভাল না থাকায় দেশে সুযোগ পান না। অন্য দিকে, প্রবেশিকা ছাড়াই ভর্তি হওয়া যায় ইউক্রেনে। আর তাতেই ভারতীয় পড়ুয়াদের কাছে আরও অনেক দেশের পড়ুয়াদের মতো ইউক্রেন হয়ে উঠেছে ডাক্তারি পড়ার মহাতীর্থ।