ছেলে সফিকুলের দেহ নিয়ে মালদহ মেডিক্যাল কলেজ ও হাসপাতাল থেকে বেরোচ্ছেন রফিকুল। শনিবার। নিজস্ব চিত্র
বাড়ির কাছে বাঁশবাগানে খেলছিল চার শিশু। কারও বয়সই বছর সাতেকের বেশি নয়। খেলতে খেলতেই হঠাৎ অসুস্থ হয়ে পড়ে ওরা। কিন্তু বাড়ির লোক তৎক্ষণাৎ কাছের গ্রামীণ হাসপাতাল বা মালদহ মেডিক্যালে নিয়ে যাওয়ার বদলে ডাক দেন এলাকার গুণিনকে। সেই ঝাড়ফুঁকের পরে আরও অসুস্থ হয়ে পড়ে ওই চার শিশু। কারও কারও বমি হতে থাকে। কারও নাক-মুখ দিয়ে রক্ত বার হয়, পেটও ফুলে যায়। তার পরেই টনক নড়ে পরিবারের। গ্রামীণ হাসপাতালে না-গিয়ে সরাসরি প্রায় ৪০ কিলোমিটার দূরে মালদহ মেডিক্যাল কলেজে নিয়ে যাওয়া হয় তাদের। সেখানে ফিরোজ আলিকে (৬) মৃত বলে ঘোষণা করা হয়। এ দিন ভোরে মৃত্যু হয় সফিকুল ইসলামের (৫)। অন্য দুই শিশু কোহিনুর খাতুন ও তার বোন সাবনুর চিকিৎসাধীন।
শুক্রবার বিকেলের এই ঘটনা শনিবার সকালে জানাজানি হয়। এই ঘটনায় জড়িত সন্দেহে এক গুণিনকে গ্রেফতার করে পুলিশ। মালদহের পুলিশ সুপার অলোক রাজোরিয়া সেই তথ্য জানিয়ে বলেন, ‘‘তদন্ত চলছে।’’
গাজল ব্লকের আলাল গ্রাম পঞ্চায়েতের কদমতলা গ্রাম থেকে মালদহের সদর শহর ইংরেজবাজারের দূরত্ব মোটে ৪০ কিলোমিটার। গ্রাম থেকে মাত্র ১০ কিমি দূরে রয়েছে গ্রামীণ হাসপাতালও। তা সত্ত্বেও কেন গ্রামের লোকজন অসুস্থ শিশুদের নিয়ে হাসপাতালে যাওয়ার বদলে গুণিনের কাছে গেল?
কোহিনুরের মামা, সামসি কলেজের দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্র আসফিক আলম বলেন, ‘‘আমি বাচ্চাদের হাসপাতালে নিয়ে যেতেই চেয়েছিলাম। কিন্তু পরিবার ও গ্রামের অনেকে বাধা দেন। ওঁরা বলেন— ওদের নাকি ভূতে ধরেছে, হাসপাতালে নিয়ে গিয়ে ইঞ্জেকশন দিলে আরও ক্ষতি হবে। পরে ওদের শরীর আরও খারাপ হলে কারও কথা শুনিনি। না হলে বোনঝিকে বাঁচাতে পারতাম না।’’
সফিকুল ইসলাম ও ফিরোজ আলি
মৃত ফিরোজের বাবা আব্দুল খাবির দিনমজুর। তিনি বলেন, ‘‘ছেলেমেয়েদের ভূতে ধরেছে বলে গ্রামের অনেকে বলেছিলেন। তাই গুণিন ডেকে ঝাড়ফুঁক করা হয়। এমন হবে ভাবতেও পারিনি।’’
স্থানীয়দের একাংশ জানিয়েছে, শুক্রবার বিকেলে যখন বাঁশবাগানে খেলতে খেলতে ওই চার শিশু অসুস্থ হয়ে পড়ে, তখন কিন্তু পরিবার ও পড়শিদের বেশির ভাগই বলতে থাকেন, ওদের ‘ভূতে ধরেছে’। হাসপাতালে নিয়ে যাওয়ার কথা আসফিকের মতো দু’-এক জন বললেও বাকিরা ডেকে আনেন গুণিন মহম্মদ রফিককে। তাকে শনিবার পুলিশ গ্রেফতার করেছে। পুলিশ জানায়, গুণিন মহম্মদ রফিক জেরায় জানিয়েছে, শিশুদের শারীরিক অবস্থা দেখেই সে হাসপাতালে নিয়ে যাওয়ার পরামর্শ দিয়েছিল।
আলাল-কাহিনি
• গ্রামের নাম আলাল। ১২ কিমি দূরে গাজল, ইংরেজবাজার ৪০ কিমি।
• প্রাথমিক স্কুলের দূরত্ব ১ কিমি। হাইস্কুল ও মাদ্রাসা ২.৫ কিমি দূরে।
• গ্রামে শিক্ষার হার প্রায় ৪০%।
• গ্রামীণ হাসপাতাল ১১ কিমি, মালদহ মেডিক্যাল ৪০ কিমি।
• পাকা রাস্তা, আলো আছে, পাকা বাড়ি সংখ্যায় কম।
• বাসিন্দাদের অধিকাংশই দিনমজুর ।
কী ভাবে অসুস্থ হয়ে পড়ল ওই শিশুরা? স্থানীয়দের কেউ কেউ জানান, একই পরিবারের চার শিশু একসঙ্গে খেলছিল। সম্ভবত সেই সময় তারা বাঁশবাগানে মাটি থেকে তুলে কিছু মুখে দেয়, যার বিষক্রিয়ায় কিছু ক্ষণের মধ্যে অসুস্থ হয়ে পড়ে। পরে মালদহ মেডিক্যাল কলেজে সুপার তথা সহ-অধ্যক্ষ অমিতকুমার দাঁ-ও বলেন, ‘‘বিষক্রিয়া থেকে তারা অসুস্থ হয়ে থাকতে পারে বলে অনুমান
করা হচ্ছে।’’
অসুস্থ শিশুদের দেখতে হাসপাতালে যান গাজলের বিধায়ক তৃণমূলের দিপালি বিশ্বাস। তিনি বলেন, ‘‘কুসংস্কার রুখতে গ্রামে পঞ্চায়েতের মাধ্যমে সচেতনতা বাড়াতে হবে।’’
গ্রাম পঞ্চায়েত প্রধান তৃণমূলের লক্ষ্মী হালদার বলেন, ‘‘মানুষের মনে এখনও অন্ধবিশ্বাস থেকে গিয়েছে। হাসপাতালে না-গিয়ে গ্রামবাসীদের একাংশ গুণিনের কাছে যাচ্ছেন। কুসংস্কার রুখতে প্রশাসনের তরফে লাগাতার প্রচার চালানো হচ্ছে।’’
মালদহের জেলাশাসক রাজর্ষি মিত্র বলেন, ‘‘ঘটনাটি খুবই দুর্ভাগ্যজনক। গ্রামে গ্রামে সচেতনতায় জোর দেওয়া হবে।’’