গ্রাফিক: শৌভিক দেবনাথ।
চিত্র ১: রুবি মোড় থেকে গড়িয়াহাটের অটোর রুট। একটি অটো ভর্তি হতে বড় জোর ১০ মিনিট লাগত। ইদানীং লাগছে ৪০ থেকে ৪৫ মিনিট। সোমবার দুপুরে এক অটোচালক সখেদে বলছিলেন, ‘‘পুজোর বাজার মন্দা। গড়িয়াহাটের প্যাসেঞ্জারই নেই। অন্যান্য বছরে এই সময়ে লম্বা লাইন পড়ে যায় গড়িয়াহাটের প্যাসেঞ্জারদের। এ বার তো লোকই নেই।’’
চিত্র ২: সল্টলেকের একটি পাম্পের অবাঙালি কর্মীর গলায় উদ্বেগ, ‘‘আমাদের প্রতি দিনের সেল অনেক কমে গিয়েছে। একেবারে নীচে নেমে গিয়েছে বলছি না। কিন্তু পেট্রল ভরাতে আসার গাড়ি কমে গিয়েছে। লোকে ঝুটঝামেলার ভয়ে বেশি গাড়ি বার করছে না। রোজ মিছিল-মিটিং হচ্ছে তো।’’ একটু থেমে, ‘‘হয়তো অনেকে সেই মিছিলেও যাচ্ছে।’’
চিত্র ৩: বাতিল করা হচ্ছে অথবা পিছিয়ে দেওয়া হচ্ছে পর পর বিনোদনী অনুষ্ঠান। উদ্যোক্তারা মনে করছেন, এই ‘অস্থির’ সময়ে কেউ পয়সা দিয়ে টিকিট কেটে অনুষ্ঠান দেখতে বা শুনতে আসবেন না। সেপ্টেম্বরে কলকাতায় নিজের কনসার্ট পিছিয়ে দিয়েছেন শ্রেয়া ঘোষালও।
চিত্র ৪: কলকাতার পুজো আসার গন্ধ সবার আগে পাওয়া যায় কুমোরটুলিতে। সেপ্টেম্বরের গোড়ায় দুর্গার সঙ্গে সঙ্গে গণেশ, বিশ্বকর্মার প্রতিমা তৈরি দেখতেও ভিড় করেন মানুষ। ছবি তুলতে আসেন অনেকে। সে সব নেই এই সেপ্টেম্বরে। এক শিল্পী বললেন, ‘‘ঠাকুরের বায়নাও হচ্ছে না তেমন। আসলে পুজো পুজো মুডটাই নেই কারও মধ্যে।’’
বহু কর্পোরেট সংস্থা তাদের চুক্তি বাতিল করে দিচ্ছে। চুক্তি বাতিল করছে বিজ্ঞাপনী সংস্থাও। তাদের বক্তব্য, মানুষ শান্ত সময়ে কেনাকাটা করেন। তাঁরা তখন উপভোক্তা (কনজ়িউমার) হন। এখন যে সময় চলছে, তাতে মানুষ কিছু কেনাকাটা করবেন না। তাঁদের সেই মানসিকতা নেই।
আরজি কর-কাণ্ডের পরে এমন টুকরো টুকরো ছবি দেখা যাচ্ছে কলকাতা শহর এবং বৃহত্তর কলকাতায়। এটা ঠিক যে, এখনও এমন চিত্র ব্যাপক হারে দেখা যাচ্ছে না। ফলে এটিই যে ‘ধ্রুব’, তা নয়। কিন্তু অনেকেই একে আগামীর ‘সূচক’ বলে মনে করছেন। বিশেষত, পুজোর আগে। কারণ, আন্দোলন থামার কোনও লক্ষণ নেই। বরং তা আরও ছড়াচ্ছে। কেউ জানেন না, এই আন্দোলন কমবে বা থামবে কি না। এই আবহে পশ্চিমবঙ্গে যে পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে, তাতে ‘পুজো অর্থনীতি’তে অশনি সঙ্কেত দেখা দিয়েছে। অনেকে মনে করছেন, এমন চললে পুজো তো মাটি হবেই, পুজোর সঙ্গে বিভিন্ন অর্থনৈতিক কারণে জড়িতেরা বড় মাপের আর্থিক ক্ষতির সম্মুখীন হবেন। সামগ্রিক ভাবে অর্থনৈতিক লোকসানের মুখে পড়বে গোটা রাজ্য।
ইতিমধ্যেই ক্ষতি হতে শুরু করেছে বিভিন্ন ব্যবসায়। তার মধ্যে যেমন রয়েছে মিষ্টি, তেমনই রয়েছে গয়না। কিন্তু প্রণিধানযোগ্য বিষয় হল, ব্যবসায়ী সংগঠনগুলির কর্ণধারদের একাংশ জানাচ্ছেন, তাঁদের ব্যবসায় ক্ষতি স্বীকার করেও তাঁরা আন্দোলনের ‘পাশে’ রয়েছেন। থাকবেন। কারণ, যে বিষয়ে আন্দোলন হচ্ছে, তাতে তাঁদের সমর্থন রয়েছে।
আগামী ২ অক্টোবর মহালয়া। তার ঠিক এক মাস আগে ২ সেপ্টেম্বর, সোমবার। এই সময়ে পুজোর কেনাকাটা শুরু হয়ে যাওয়াই চল বাংলায়। গড়িয়াহাট, নিউ মার্কেট থেকে হাতিবাগানে দুপুরের পর থেকে ক্রেতাদের ঢল নামে। সপ্তাহ শেষের ছুটির দিনে তো বটেই। কিন্তু এই বছরে অন্য ছবি। এ সব বাজার সংলগ্ন রাস্তায় মানুষের ঢল নেমেছে। কিন্তু তাঁদের হাতে ‘বিচার চাই’ পোস্টার। বিভিন্ন জেলায় মফস্সল শহরগুলির ছবিও মোটের উপর একই। মিছিলের পর মিছিল চলছে প্রতি দিন। বিশ্বকর্মা পুজোর ১৫ দিন আগেও দুর্গোৎসবের ‘মুড’ নেই রাজ্যবাসীর। ব্যবসা ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। সেই আশঙ্কা কুমোরটুলিতেও।
কুমোরটুলিও খাঁ-খাঁ করছে। সেপ্টেম্বরে পর পর দুই পুজো। গণেশ এবং বিশ্বকর্মা পুজো দোরগোরায়। দুর্গাপুজো এই পাড়ার সব চেয়ে বড় উৎসব। দোমেটে হয়ে প্রতিমার গায়ে রং লাগানোর কাজও শুরু হয়ে গিয়েছে। কিন্তু তেমন ভাবে দোকানে দোকানে ঘোরা পুজো উদ্যোক্তাদের দল নেই। কুমোরটুলি মৃৎশিল্পী সমিতির সম্পাদক কার্তিক পাল বলছেন, ‘‘আর জি করের নৃশংস ঘটনার বিচার আমরা সবাই চাইছি। যে ভাবে শহরে প্রতিবাদের ঢল নেমেছে, তার পাশে আছে কুমোরটুলিও। সেই জন্যই এ বার এখানে ক্যামেরা হাতে ছেলেমেয়েদের ভিড় নেই। এমনকি, সপ্তাহান্তেও শুনশান থাকছে কুমোরপাড়া। সকলেই মিছিলে পা মেলাচ্ছেন, প্রতিবাদ করছেন।’’
লোকসানের আশঙ্কা করছে ‘খাদ্যশিল্প’ও। কারণ, এমন চলতে থাকলে মানুষের ভাল খাওয়ার রুচিও থাকবে না। তেমনই মনে করছেন ‘ন্যাশনাল রেস্তরাঁ অ্যাসোসিয়েশন অফ ইন্ডিয়া’র সর্বভারতীয় সহ-সভাপতি সাগর দারইয়ানি। তাঁর কথায়, ‘‘সারা বছরের তুলনায় রেস্তরাঁর ব্যবসা পুজোর আগে এবং পুজোর সময়েই ভাল হয়। কিন্তু এখন যা চলছে, তাতে পুজো সেলিব্রেশনের স্পিরিটটাই কমে গিয়েছে মানুষের।’’ ব্যবসা আগের মতো হবে না ধরে নিয়েও সাগর অবশ্য মনে করছেন, সিবিআই যদি কিছু করতে পারে, তবেই পরিস্থিতির কিছুটা উন্নতি হতে পারে। তিনি জানান, অগস্ট মাসের শেষ ১৫ দিনে ১৫ শতাংশ খারাপ গিয়েছে বাজার। এর পরে সেপ্টেম্বরেও একই পরিস্থিতি চলতে থাকলে সেই ক্ষতি ৩০ শতাংশ হয়ে যেতে পারে। সাগর বলেন, ‘‘বিভিন্ন বাজারের ভিতরের রেস্তরাঁগুলির অবস্থা খারাপ। কারণ, অনেকেই কেনাকাটার সঙ্গে খাওয়াদাওয়া করেন। সেই বাজারটা একেবারেই নেই।’’ কলকাতা শহরের মধ্যে ধর্মতলা, নিউ মার্কেট, পার্ক স্ট্রিট, শ্যামবাজার এবং গড়িয়াহাটের রেস্তরাঁগুলি ইতিমধ্যেই ‘চাপে’ বলেও জানান তিনি। সাগরের দাবি, একই পরিস্থিতি শপিং মলের ভিতরের রেস্তরাঁগুলিতেও।
পুজোয় মিষ্টির বাজারেও বিপুল ক্ষতির আশঙ্কা রয়েছে। দুর্গাপুজো মিষ্টান্ন বিক্রেতাদের জন্য গুরুত্বপূর্ণ সময়। কিন্তু ব্যবসায়ীদের সংগঠন মিষ্টি উদ্যোগের রাজ্য সভাপতি ধীমান দাশ বলছেন, ‘‘বিশ্বকর্মা পুজো থেকে দীপাবলি পর্যন্ত পুজোর সময়ের লাভ দিয়েই বাকি সারা বছর ব্যবসা হয়। সেই সময়টাতেও আন্দোলন চললে খুবই সমস্যা।’’ সুপরিচিতি রসগোল্লা প্রস্তুতকার বিপণি কেসি দাশ অ্যান্ড সন্সের কর্ণধার ধীমান আরও জানান, ধর্মতলায় তাঁদের বিপণির দৈনিক বিক্রি ইতিমধ্যেই ৭০ শতাংশ কমে গিয়েছে। ফলে উৎপাদনও কমাতে হয়েছে। কারণ, তাঁদের বিপণির অনতিদূরে চলছে বিজেপির ধর্না-অবস্থান। বহু মিছিল এসে শেষ হচ্ছে ধর্মতলার ডোরিনা ক্রসিং বা রানি রাসমণি অ্যাভিনিউয়ে। কিন্তু একই সঙ্গে ধীমান বলছেন, ‘‘তবে যে ঘটনা নিয়ে আন্দোলন চলছে, তাতে আমাদের সমর্থন রয়েছে। তাই ক্ষতি স্বীকার করতেও আমরা তৈরি। এই সমস্যার সমাধান না হওয়া পর্যন্ত ভাল বাজারও চান না বাংলার মিষ্টান্ন ব্যবসায়ীরা।’’
একই অভিমত গয়নাশিল্পের সঙ্গে যুক্ত মালিকদের সংগঠনেও। ‘স্বর্ণশিল্প বাঁচাও কমিটি’র কার্যকরী সভাপতি বাবলু দে বলেন, ‘‘করোনার সময়েও তো ক্ষতি হয়েছিল। সেটা ছিল মহামারী। আর এটা মহাবিপদ।’’ তবে রাজ্যে আন্দোলনের যে ‘ঝাঁজ’, তাতে ইতিমধ্যেই গয়নার ব্যবসা অগস্ট মাসে ৯০ শতাংশ কমেছে। অলঙ্কার বিপণির কর্ণধার বাবলুর কথায়, ‘‘পুজোর বাজারের ঠিক কতটা ক্ষতি হবে, সেটা এখনই আন্দাজ করা যাচ্ছে না।’’ তবে একই সঙ্গে তিনি এ-ও বলছেন, ‘‘তবে যা-ই হোক, আমরা তার জন্য তৈরি। আমরা আন্দোলনকে দোষ দেব না।’’
রাজ্যের সার্বিক ব্যবসা পরিস্থিতি যে খারাপ হবে, তা মনে করছে ‘কনফেডারেশন অফ ওয়েস্ট বেঙ্গল ট্রেড অ্যাসোসিয়েশন’ও। সংগঠনের রাজ্য সভাপতি সুশীল পোদ্দারের কথায়, ‘‘এখনও পর্যন্ত যা অবস্থা, তাতে খুব খারাপ আশঙ্কা করছি। নবান্ন অভিযান আর বাংলা বন্ধ মিলিয়ে দু’দিনে ৫০০ থেকে ৬০০ কোটি টাকার ক্ষতি হয়ে গিয়েছে।’’ তাঁর দাবি, ‘‘যাবতীয় খুচরো ব্যবসায় ক্ষতি হচ্ছে। সেটা টের পাওয়া যাচ্ছে বড়বাজারের হাল দেখেই। পাইকারি বাজার খারাপ মানে খুচরো বিক্রেতারা পণ্য তুলছেন না। তাঁরা বুঝে গিয়েছেন, ক্রেতাদের কেনাকাটার মুড নেই।’’ সপ্তাহখানেকের মধ্যে পুজোর কেনাকাটা পুরোদমে শুরু না হলে ক্ষতির পরিমাণ ‘বিপুল’ হবে বলেই দাবি সুশীলের। তিনি জানান, পুজোর সময় প্রতি দিন রাজ্যে ২০০ কোটি টাকার বাজার হয়। পুজোর সপ্তাহে দেড় হাজার কোটির মতো।
অশনি সঙ্কেতই বটে!