নাগরিক আন্দোলনের বিরুদ্ধে এমন কুকথা এবং হুমকির স্রোত কেন? গ্রাফিক: শৌভিক দেবনাথ।
তৃণমূল সাংসদ কাকলি ঘোষ দস্তিদার তাঁর মন্তব্যের জন্য প্রকাশ্যে ক্ষমা চেয়েছেন। অশোকনগরের নেতা অতীশ সরকারের মন্তব্য নিয়ে নিন্দা শুরু হতেই এক বছরের জন্য তাঁকে দল থেকে সাসপেন্ড ( নিলম্বিত) করেছে তৃণমূল। কিন্তু তালিকায় আরও অনেকে আছেন। বাঁকুড়ার সাংসদ অরূপ চক্রবর্তী, উত্তরবঙ্গ উন্নয়নমন্ত্রী উদয়ন গুহ, উত্তরপাড়ার তৃণমূল বিধায়ক তথা অভিনেতা কাঞ্চন মল্লিক, অভিনেত্রী তথা সোনারপুরের বিধায়ক লাভলি মৈত্র। তাঁদের কথা যে দলকে ‘বিড়ম্বনায় ফেলছে’, তা মানছেন প্রথম সারির তৃণমূল নেতারাও। কিন্তু তাঁদের থামার নাম নেই। থামানোরও উদ্যোগ আছে কি?
নাগরিক আন্দোলনের ‘চাপ’ ক্রমশ বাড়তেই কি ‘অসংলগ্ন’ কথা বলছেন শাসকদলের ওই নেতা-নেত্রীরা? সেই আন্দোলনের নিয়ন্ত্রণ যখন পাড়ায় পাড়ায় সাধারণ মহিলাদের হাতে চলে যাচ্ছে, তখন কি শাসকের একাংশের স্নায়ু আরও নড়বড়ে এবং অসংলগ্ন হয়ে পড়ছে? যার বহিঃপ্রকাশ সরাসরি হুমকি।
বাম জমানার শেষ পর্বে সিঙ্গুর-নন্দীগ্রাম, রিজওয়ান রহমানের মৃত্যু, নেতাইকাণ্ড ঘটেছিল। সেই পর্বেও দেখা গিয়েছিল নাগরিক আন্দোলন। যা ক্রমে রাজনৈতিক আন্দোলনে পর্যবসিত হয়েছিল। সেই সময়েও তৎকালীন সিপিএম নেতা অধুনাপ্রয়াত অনিল বসু, বিনয় কোঙারদের বিভিন্ন মন্তব্যের তীব্র সমালোচনা হয়েছিল। জেলায় জেলায় অনেক সিপিএম নেতাই দলকে ‘চাঙ্গা’ করতে সেই সব কথা বলতেন। তাতে দল কতটা চাঙ্গা হয়েছিল, সেটা সিপিএম জানলেও মানুষ যে তা গ্রহণ করেননি, তা-ও স্পষ্ট হয়ে গিয়েছিল।
এখনও পর্যন্ত আরজি কর-কাণ্ডে প্রতিবাদ নাগরিক আন্দোলনের পর্যায়েই রয়েছে। এবং সেই আন্দোলন যে পর্যায়ে গিয়েছে, তা এই রাজ্য সাম্প্রতিক কালে দেখেনি। মূলধারার রাজনৈতিক দলগুলি নিজেদের মতো করে কর্মসূচি করলেও নাগরিক আন্দোলনকে দলীয় রং দিতে পারেনি। ক্রমশ সেই নাগরিক আন্দোলন যে ‘বিচারের দাবি’ থেকে তৃণমূল বিরোধিতার পর্যায়ে পৌঁছচ্ছে, তা-ও ঘরোয়া আলোচনায় মেনে নিচ্ছেন শাসকদলের নেতারা। গত ১৪ অগস্ট ‘মেয়েদের রাত দখল’ কর্মসূচির মূল স্লোগান ছিল, ‘তোমার স্বর, আমার স্বর, আরজি কর আরজি কর’ কিংবা ‘উই ওয়ান্ট জাস্টিস’। অর্থাৎ, শুধু বিচার চাওয়ার মধ্যেই আন্দোলনের দাবি সীমাবদ্ধ ছিল। পাড়ায় পাড়ায় তৈরি হওয়া হোয়াট্সঅ্যাপ গ্রুপের ‘অ্যাডমিন’রা পইপই করে বলে দিয়েছিলেন, কোনও রাজনৈতিক স্লোগান চলবে না। সেই স্লোগান ওঠেওনি। কিন্তু তার পরে ১৬ দিন পেরিয়ে গিয়েছে। রবিবারের নাগরিক মিছিল এবং মিছিলের শেষে সারা রাত ধর্মতলার অবস্থান থেকে দফায় দফায় স্লোগান উঠেছে, ‘শাসক তোমার কিসের ভয়? ধর্ষক তোমার কে হয়?’ কোনও দলের রং লাগেনি ঠিকই। কিন্তু নাগরিক আন্দোলন ক্রমশ যে রাজনৈতিক অভিমুখে এগোচ্ছে, তা-ও অনেকের কাছে স্পষ্ট।
এই আবহে শাসকদলের নেতাদের হুমকি এবং মহিলাদের সরাসরি আক্রমণের হুঁশিয়ারি রয়েছে। গত লোকসভা ভোটে বাঁকুড়া আসন বিজেপির কাছ থেকে ছিনিয়ে নিয়েছে তৃণমূল। সেই বাঁকুড়ার সাংসদ অরূপ বলেছেন, ‘‘এরা অনেক বেড়ে গিয়েছে। অনেক মিথ্যা অপপ্রচার করছে। এখানে-ওখানে গিয়ে মানুষকে বলছে, কন্যাশ্রী, পুজোর অনুদান, লক্ষ্মীর ভান্ডার চাই না। ক্ষমতা থাকলে যাঁরা সরকারি প্রকল্পের সুবিধা চান না, তাঁদের নিয়ে একটা মিছিল করে দেখাও!’’ পাশাপাশিই তিনি বলেছেন, “কুকুরের মতো গুজুর গুজুর, ফুসুর ফুসুর করবে। আর ইনকিলাব জিন্দাবাদ বলে কাস্তে-হাতুড়ি দেখাবে! ভোটের আগের দিন পদ্মফুলে ভোট দিতে বলবে। তোমাদের কেউ বিশ্বাস করে না।’’
রাজ্যের মন্ত্রী উদয়ন গুহ বলেছেন, ‘‘ওরা যদি একটা দংশন করে, তা হলে আমাদের পাঁচটা দংশন করতে হবে। ওরা একটা দাঁত বসালে আমাদের পাঁচটা দাঁত বসাতে হবে। তা হলে ওদের মিথ্যাচার বন্ধ হবে।’’ মন্ত্রী আরও বলেছেন, ‘‘আরজি কর হাসপাতালে যে ঘটনা ঘটেছে, সেটাকে সামনে রেখে কিছু রাজনৈতিক দল চক্রান্ত করছে। একটা অশান্তির পরিবেশ তৈরি করতে চাইছে । সে দিকে সতর্ক থাকতে হবে। সজাগ থাকতে হবে। ঐক্যবদ্ধ ভাবে চক্রান্তের মোকাবিলা করতে হবে।’’
বিধায়ক লাভলি বলেছেন, ‘‘মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের দিকে আঙুল তুললে সেই আঙুল কী ভাবে নীচে নামিয়ে দিতে হয়, সেটা আমরা জানি! এখনও পর্যন্ত শান্ত আছি।’’ অপর অভিনেতা-বিধায়ক কাঞ্চন মল্লিক আন্দোলরতম জুনিয় ডাক্তারদের প্রায় নজিরবিহীন ভাষায় কটাক্ষ করেছেন। বলেছেন, “ওই চিকিৎসকেরা আন্দোলন করছেন ঠিকই। কিন্তু বোনাস বা প্রভিডেন্ট ফাণ্ড নেবেন তো?’’
সোমবার দল থেকে সাসপেন্ড হওয়া অশোকনগরের তৃণমূল নেতা অতীশ বলেছিলেন, ‘‘আমরা যদি ফোঁস করি, আপনার বাড়ির মা-বোনদের কুৎসা রটিয়ে যদি দরজায় টাঙিয়ে দিয়ে আসি, তা হলে সেই পোস্টার খুলতে পারবেন না।’’ ঘটনাচক্রে, অতীশ যে মঞ্চে দাঁড়িয়ে ওই কথা বলেছিলেন, তার পিছনে ব্যানারে লেখা ছিল ‘মা-বোনেদের সম্মান, আমাদের সম্মান’।
নাগরিক আন্দোলন যখন শাসকদলের বিরুদ্ধে মনোভাবকে প্রকাশ্যে আনছে, তখন তৃণমূলও সংগঠনকে রাস্তায় নামাতে চেয়েছে। ধর্না-মিছিলের পাল্টা কর্মসূচি হয়েছে গত তিন ধরে। কিন্তু জমায়েতের হাল যে সর্বত্র আশানুরূপ ছিল না, তা মানছেন শাসকদলের অনেক নেতা। মূলত সেই জমায়েতগুলি থেকেই আরূপ, উদয়ন, লাভলি, অতীশেরা ওই সব মন্তব্য করেছেন।
দল কি তাঁদের এ নিয়ে কিছু বলেছে?
তৃণমূলের অন্যতম মুখপাত্র তথা কলকাতা পুরসভার ৯৮ নম্বর ওয়ার্ডের কাউন্সিলর অরূপ চক্রবর্তী বলেন, ‘‘অশোকনগরের ঘটনায় তৃণমূল প্রমাণ করল যে, আমাদের দল ব্যতিক্রমী। কাউকে রেয়াত করে না। কিন্তু গত লোকসভার শেষ দিন পর্যন্ত নরেন্দ্র মোদী ব্রিজভূষণ সিংহকে পাশে নিয়ে সংসদে ছিলেন। মোদীর কেন্দ্র বারাণসীতেই ধর্ষণে অভিযুক্ত বিজেপি নেতাদের ফুলমালায় বরণ করা হয়েছে। কিন্তু তৃণমূল পদক্ষেপ করে দৃষ্টান্ত তৈরি করেছে। বাঁকুড়ার অরূপ চক্রবর্তী এবং উদয়ন গুহকেও দলীয় স্তরে সতর্ক করা হয়েছে।’’
কিন্তু নাগরিক আন্দোলনের বিরুদ্ধে এমন কুকথা এবং হুমকির স্রোত কেন? শাসকদলের তরফে অবশ্য বলা হচ্ছে, ওই নেতারা ‘রাজনৈতিক বিরোধী’ বিজেপি এবং সিপিএমকে বলতে চেয়েছেন। কিন্তু আরজি কর-আন্দোলনে প্রথাসিদ্ধ রাজনৈতিক দলের তুলনায় নাগরিক সমাজ অনেক এগিয়ে। ফলে মোটের উপর মনে হচ্ছে, এ সব বর্ষিত হচ্ছে সাধারণ আন্দোলনকারীদের উদ্দেশ্যেই। কেন?
অধ্যাপক তথা সমাজকর্মী শাশ্বতী ঘোষের বক্তব্য, ‘‘এর কারণ তিনটি। এক, দলে নম্বর বাড়াতে। দুই, এঁরা দল এবং সরকারকে গুলিয়ে ফেলছেন। যা আমরা আগের শাসকের আমলেও দেখেছি। তৃতীয়ত, মেয়েদের শাসনে রাখতে চাওয়ার মনোভাব।’’ প্রেসিডেন্সি বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞানের প্রাক্তন বিভাগীয় প্রধান প্রশান্ত রায় আবার ওই হুমকির সঙ্গে মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের ‘ফোঁস’ মন্তব্যের ‘যোগ’ দেখছেন। তাঁর কথায়, ‘‘মুখ্যমন্ত্রী ফোঁস করার কথা বলেছেন। তার পরেই এই ধরনের কথার বাড়বাড়ন্ত দেখা যাচ্ছে। এই আন্দোলনে সমাজের সমস্ত অংশ নেমেছে। সোনাগাছির যৌনকর্মী থেকে সেক্টর ফাইভের আইটি কর্মী— সকলে। তাতেই সম্ভবত শাসকদল চিন্তিত। এই ভাষা তারই বহিঃপ্রকাশ।’’ ভাষাবিদ তথা রবীন্দ্রভারতীর প্রাক্তন উপাচার্য পবিত্র সরকারের কথায়, ‘‘নাগরিক আন্দোলন যে স্বতঃস্ফূর্ততার সঙ্গে অগ্রসর হচ্ছে, তা আমরা দেখতে পাচ্ছি। শাসকদলের নেতাদের এই কথাগুলি থেকে এ-ও বুঝতে পারছি, তাঁদের উপর চাপ তৈরি হচ্ছে। না হলে তাঁরা এই কথাগুলি বলছেন কেন?’’
দলের উপর যে ‘চাপ’ তৈরি হয়েছে, তা মানছেন তৃণমূলের প্রথম সারির নেতারা। মানুষের ক্ষোভ যে পর্যায়ে পৌঁছেছে, তাতে অরূপ, উদয়ন, কাকলি, লাভলিদের মন্তব্য কাটা ঘায়ে নুনের ছিটের মতো হয়ে দাঁড়াচ্ছে। তাঁরা এ-ও মানছেন যে, লোকসভা নির্বাচনে বিপুল জয়ের দু’-আড়াই মাসের মধ্যে যে এই পরিস্থিতি হবে, তা তাঁদের ধারণার মধ্যে ছিল না। কিন্তু নেতাদের মুখে লাগাম পরানো যাচ্ছে না।