দ্বিতীয় নির্দেশ, নেটমাধ্যমে পার্থের শাস্তির সিদ্ধান্ত নিয়ে লাগাতার প্রচার চালাতে হবে। গ্রাফিক: শৌভিক দেবনাথ।
পার্থ চট্টোপাধ্যায় এবং এসএসসি দুর্নীতি নিয়ে দুমদাম মুখ খোলার প্রয়োজন নেই। কেউ কোনও প্রশ্ন করলে বা আলোচনা করতে চাইলে হয় চুপ করে থাকুন বা হেসে এড়িয়ে যান। দলের নীচুতলায় এমনই নির্দেশ পাঠিয়েছেন তৃণমূলের শীর্ষ নেতৃত্ব। পাশাপাশিই নির্দেশ দেওয়া হয়েছে, আপাতত কোনও পথসভা বা জনসভা করা বা কোনও জমায়েতে যোগ দেওয়ার প্রয়োজন নেই। যা বলার শীর্ষ নেতৃত্ব বলবেন। গত সপ্তাহে দুর্নীতির মামলায় পার্থকে গ্রেফতার করা এবং তাঁর ‘ঘনিষ্ঠ’ অর্পিতা মুখোপাধ্যায়ের দু’টি ফ্ল্যাট থেকে ৫০ কোটিরও বেশি নগদ টাকা, বিদেশি মুদ্রা এবং স্বর্ণালঙ্কার উদ্ধারের পরেই ঘোর ‘অস্বস্তি’-তে শাসকদল। প্রাথমিক হতচকিত ভাব কাটিয়ে এখন দলের শীর্ষ নেতৃত্ব চেষ্টা করছেন সেই ক্ষত মেরামত করার। যদিও তাতে কাজ কতটা হবে, তা এখনই কেউ হলফ করে বলতে পারছেন না।
বিভিন্ন পর্যায়ে সেই মেরামতির কাজ শুরু হয়েছে। যার মূল নীতি হল— রাজনৈতিক ভাবে ‘আক্রমণাত্মক’ হওয়া। তার পাশাপাশিই তৃণমূল স্তরের সংগঠনে আপাতত নীরবতা অবলম্বন। সাধারণ ভাবে কারও সঙ্গে কোনও বাদানুবাদে জড়িয়ে না-পড়া। কেউ পার্থকে নিয়ে কিছু বললে হয় চুপচাপ থাকা অথবা হেসে অন্য প্রসঙ্গে চলে-যাওয়া। এমনিতেই বিপুল পরিমাণ অর্থ এবং অলঙ্কার উদ্ধারের ঘটনার পর রাজ্যের মন্ত্রীরাও যথেষ্ট ‘অস্বস্তি’-তে। মন্ত্রীরা নিজেদের মধ্যে আলোচনায় বিষয়টি মেনেও নিচ্ছেন। সম্প্রতি এক মন্ত্রী যেমন একান্ত আলোচনায় স্বীকার করেছেন, ‘‘বাইরে বেরোনো যাচ্ছে না! সকলের মুখে এই একটাই আলোচনা। কান পাতা যাচ্ছে না!’’ এই পরিস্থিতিতে দলের বিভিন্ন স্তরে বিবিধ পদক্ষেপ করতে শুরু করেছেন শাসকদলের শীর্ষ নেতৃত্ব। তার মধ্যে প্রথমটি হল, দুর্নীতির দায়ে ধৃত পার্থের সঙ্গে সরকার এবং দলের যাবতীয় সংশ্রব চুকিয়ে দেওয়া। যা ইতিমধ্যেই করা হয়েছে। পার্থকে সরাসরি বহিষ্কার না-করে সাসপেন্ড করা হয়েছে ঠিকই। কিন্তু বলা হয়েছে, তদন্ত শেষ না-হওয়া পর্যন্ত তাঁকে সাসপেনশনে থাকতে হবে। এই ধরনের তদন্ত যে বহু বছর ধরে চলে, তা মোটামুটি সকলেরই জানা। ফলে পার্থ আনুষ্ঠানিক ভাবে সাসপেন্ড হলেও প্রকারান্তরে তিনি বহিষ্কৃতই হলেন বলা যায়। অর্থাৎ, দল তাঁর সঙ্গে দীর্ঘমেয়াদি দূরত্ব তৈরি করল। এটি হল পার্থকে নিয়ে জনমানসে তৈরি-হওয়া ক্ষোভ মোকাবিলায় প্রথম পদক্ষেপ। যা একটি ‘আক্রমণাত্মক’ পদক্ষেপ বলেই দলের নেতাদের ব্যাখ্যা। যদিও তাঁদের একাংশের অভিমত, পার্থ গ্রেফতার হওয়ার পরেই এমন সিদ্ধান্ত নেওয়া উচিত ছিল। নইলে এই ‘আক্রমণাত্মক’ পদক্ষেপকেও ‘রক্ষণাত্মক’ এবং ‘চাপের মুখে’ নেওয়া বলে মনে হওয়ার অবকাশ রয়েছে। অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায় অবশ্য পার্থ সম্পর্কে সিদ্ধান্ত ঘোষণা করতে গিয়ে জানিয়েছেন, সিদ্ধান্ত নিতে একটু সময় লাগা স্বাভাবিক। পাশাপাশিই তিনি বলেছেন, ‘‘এমন সিদ্ধান্ত দেশের আর কোনও দল নিতে পারেনি। পারবেও না।’’
দ্বিতীয় নির্দেশ, নেটমাধ্যমে পার্থের শাস্তির সিদ্ধান্ত নিয়ে লাগাতার প্রচার চালাতে হবে। যা বৃহস্পতিবার পার্থের শাস্তি ঘোষণার পরেই শুরু হয়ে গিয়েছে। দলের তরুণ প্রজন্মের নেতানেত্রীরা তাঁদের নেটমাধ্যমে সক্রিয় হয়েছেন। তৃতীয়ত, দলের নিচুতলায় নির্দেশ গিয়েছে, আপাতত পার্থ এবং এসএসসি দুর্নীতি নিয়ে কারও সঙ্গে আলোচনা বা বিতর্কে জড়ানোর প্রয়োজন নেই। প্রকাশ্যে কোথাও মাইক বেঁধে সভা করা যাবে না। কোনও জমায়েতও করা যাবে না। পার্থ এবং এসএসসি দুর্নীতি নিয়ে কোথাও মুখ খোলার দরকার নেই। কেউ জানতে চাইলে বা আলোচনা করতে চাইলে কোনও মন্তব্য করার প্রয়োজন নেই। হাসিমুখে নীরব থাকতে হবে। দলীয় সূত্রের খবর, পার্থ গ্রেফতার হওয়ার পর দলের একটি অংশের ‘সহানুভূতি’ তাঁর সঙ্গে ছিল। বস্তুত, দলের সর্বময় নেত্রী তথা মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের কণ্ঠেও পার্থ সম্পর্কে খানিকটা ‘নমনীয়তা’ ছিল। তিনি বলেছিলেন, ‘‘আইনের চোখে কেউ দোষী প্রমাণিত হলে শাস্তি হোক। যাবজ্জীবন কারাদণ্ড হলেও আই ডোন্ট মাইন্ড! কিন্তু আইনের চোখে দোষী প্রমাণিত হতে হবে।’’ বস্তুত, পার্থকে মন্ত্রিত্ব থেকে সরানোর আগের দিনও মুখ্যমন্ত্রী হিন্দমোটরের একটি কর্মসূচিতে গিয়ে বলেছিলেন, ‘‘একটা বড় প্রতিষ্ঠান চালালে ছোটখাটো ভুল হতেই পারে।’’
মুখ্যমন্ত্রীর পাশাপাশিই দলের সাংগঠনিক নেতৃত্বও প্রথমে খানিকটা ‘ধীরে চলো’ নীতি নিতে গিয়েছিলেন। কারণ, পার্থকে গ্রেফতারের অব্যবহিত পরে নিজেদের মধ্যে বৈঠক করেছিলেন সংগঠনের শীর্ষ নেতারা। সেখানে সিদ্ধান্ত হয়েছিল, পার্থের বিরুদ্ধে কোনও অভিযোগ আদালতে প্রমাণিত হলে দল কঠোরতম ব্যবস্থা নেবে। সেই মতোই দলের মুখপাত্র তথা রাজ্য সম্পাদক কুণাল ঘোষ গত শনিবার সেই সিদ্ধান্তের কথা ঘোষণা করেছিলেন। যার মধ্যে এমন ইঙ্গিত ছিল যে, আইনের চোখে দোষী প্রমাণিত না-হওয়া পর্যন্ত পার্থ সম্পর্কে খানিকটা ‘নমনীয়’ মনোভাব নেবে শাসকদল। কিন্তু যে বিপুল পরিমাণ নগদ টাকা প্রথম দফায় অর্পিতার ডায়মন্ড সিটির ফ্ল্যাট থেকে উদ্ধার করা হয়। তখনই সাংগঠনিক স্তরে তৃণমূল নেতৃত্ব নিশ্চিত হয়ে যান যে, ঘটনা ‘গোলমেলে’ দিকে গড়াচ্ছে। তাৎপর্যপূর্ণ ভাবে, রবিবারেই কুণাল একটি সাংবাদিক বৈঠক করে বলেন, ‘‘যদি কোনও অভিযুক্তের বিরুদ্ধে তদন্তকারী সংস্থা ন্যূনতম তথ্যপ্রমাণ আদালতে পেশ করে, তার ভিত্তিতেই কঠোরতম সিদ্ধান্ত নেবে দল।’’ এখানে ‘ন্যূনতম তথ্যপ্রমাণ’ শব্দবন্ধটি লক্ষ করার মতো।
ঘটনাচক্রে, তার পরেই অর্পিতার বেলঘরিয়ার ফ্ল্যাটে আরও টাকা উদ্ধারের ঘটনা ঘটে। সেই অঙ্ক ছাপিয়ে যায় প্রথম দফাকেও। ওই ঘটনা অস্বস্তি বহুগুণ বাড়িয়ে দেয় তৃণমূল নেতৃত্বের। তাঁরা অনুভব করেন, পার্থের বিরুদ্ধে কড়া শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নিতেই হবে এবং তা নিতে হবে আর কালহরণ না-করে। সেই মতোই বৃহস্পতিবার বৈঠক ডেকে দলীয় স্তরে সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। তার আগে প্রশাসনিক স্তরে সিদ্ধান্ত নিয়েছেন মমতা। একদা ‘আস্থাভাজন’ পার্থকে মন্ত্রিসভা থেকে সরিয়ে দিয়েছেন তিনি।
ক্ষত মেরামতিতে এই সমস্ত পদক্ষেপ কতটা ফলদায়ী হবে, তা এখনও স্পষ্ট নয়। কিন্তু দলের নেতারা মনে করছেন, আপাতত এই রাস্তায় হাঁটা ছাড়া কোনও উপায় নেই। এর পর তদন্ত কোন পথে এগোবে, সেটাও তাঁরা দেখে নিতে চান।