রাজ্যপাল সি ভি আনন্দ বোস। ফাইল চিত্র।
প্রাক্তন রাজ্যপাল জগদীপ ধনখড়ের সঙ্গে তুলনা টেনে বর্তমান রাজ্যপাল সি ভি আনন্দ বোসের সঙ্গে সরাসরি সংঘাতে নেমে পড়ল তৃণমূল কংগ্রেস। নিশীথ-কাণ্ডে কড়া বিবৃতি দিয়ে বোস বলেছিলেন, আইনশৃঙ্খলার অবনতি হলে রাজ্যপাল ‘চুপ’ করে থাকবেন না। দিনহাটায় কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী নিশীথ প্রামাণিকের কনভয়ে ‘হামলা’র পরে রাজ্য প্রশাসন কী পদক্ষেপ নিয়েছে, তার রিপোর্টও চাওয়া হয়েছিল রাজভবন থেকে। রাজ্যপাল বোসের ওই বক্তব্য নিয়ে রবিবারই পাল্টা সরব হয়েছিল শাসক দল। এ বার আরও এক ধাপ এগিয়ে তৃণমূলের দলীয় মুখপত্রে মন্তব্য করা হল, রাজ্যপাল বোস তাঁর পূর্বসূরি ধনখড়ের মতোই বিজেপির পরিকল্পনা কার্যকর করার চেষ্টা করছেন।
শাসক দল যখন রাজ্যপালকে নিশানা করছে, বিজেপি শিবির তখন নিশীথের কনভয়ে ‘হামলা’ ঘিরে তৃণমূলকে ‘ঘরে-বাইরে’ কোণঠাসা করার রণনীতি নিচ্ছে। এক দিকে, সরাসরি মাঠে নেমে আন্দোলন শুরু করেছে তারা। অন্য দিকে, রাজভবন ও রাজ্য নেতৃত্বের তরফ থেকে ‘চাপ’ তৈরির কৌশল নেওয়া হয়েছে। নিশীথ দাবি করেছেন, তাঁর উপরে আক্রমণ মানে দেশের স্বরাষ্ট্র মন্ত্রকের উপরেই আক্রমণ। দলের ‘আক্রান্ত’ কর্মী-সমর্থকদের পাশে দাঁড়াতে আজ, মঙ্গলবার রাজ্য বিজেপি সভাপতি সুকান্ত মজুমদারেরও দিনহাটায় যাওয়ার কথা। তবে নিশীথ-সহ যে কোনও রাজনৈতিক নেতার উপরে ‘হামলা’ নিন্দনীয় বললেও দিনহাটার ঘটনা নিয়ে নবান্নের কাছ থেকে কেন্দ্রীয় সরকার এখনও পর্যন্ত কোনও রিপোর্ট চেয়ে পাঠিয়েছে বলে প্রশাসনিক সূত্রে খবর মেলেনি।
তৃণমূলের মুখপত্রে এ দিন লেখা হয়েছে, ‘রাজ্যপাল যে আসলে বিজেপির অ্যাজেন্ডা কার্যকর করতে এসেছেন, তা প্রমাণ করেছিলেন জগদীপ ধনখড়। প্রাক্তন রাজ্যপালের পথ দ্রুত অনুসরণ করতে নেমে পড়েছেন বর্তমান রাজ্যপাল।’ সেখানে আরও মনে করিয়ে দেওয়া হয়েছে, ‘মনে রাখতে হবে রাজ্যপাল বিজেপির ক্যাডার ছিলেন’। প্রসঙ্গত, বিজেপির অভিযোগের প্রেক্ষিতে রাজ্যে বিধানসভা ভোট-পরবর্তী সন্ত্রাস পরিস্থিতি খতিয়ে দেখতে দিল্লি থেকে যে অনুসন্ধানকারী দল এসেছিল, তার সদস্য ছিলেন প্রাক্তন আইএএস বোস।
তা হলে কি য়ে রাজ্যপাল মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের উপস্থিতিতে বর্ণপরিচয় শিখলেন, মুখ্যমন্ত্রীর লেখার প্রভূত প্রশংসা করলেন, তাঁর সঙ্গে শাসক দলের ‘মধুচন্দ্রিমা’র শেষের শুরু হল? তৃণমূল নেতা সুখেন্দু শেখর রায়ের মতে, ‘‘মধুচন্দ্রিমাও ছিল না, সংঘাতও নেই! তিন বারের নির্বাচিত মুখ্যমন্ত্রী জানেন, কী ভাবে প্রশাসন পরিচালনা করতে হয়। সেখানে হস্তক্ষেপের যে চেষ্টা বিজেপি আমলে হচ্ছে, তাতে এই রকম পরিস্থিতি তৈরি হবে। আমরা এম কে নারায়ণন, কেশরীনাথ ত্রিপাঠির সঙ্গে কাজ করেছি।’’ তৃণমূল বিধায়ক মদন মিত্র এ দিনই আবার অসংসদীয় ভাষায় রাজ্যপালকে আক্রমণ করেছেন।
বিজেপির রাজ্য সভাপতি সুকান্ত অবশ্য পাল্টা বলছেন, ‘‘আগের রাজ্যপাল সংবিধান মেনে চলেছিলেন। বর্তমান রাজ্যপালও সংবিধানের পথেই চলছেন। সংবিধানকে রক্ষা করার জন্য যা পদক্ষেপ করার, করছেন। জাগো তৃণমূলের মুখপত্র কী লিখল, কিছু যায় আসে না। ওটা কেউ পড়ে না।” সিপিএমের কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য সুজন চক্রবর্তীর কটাক্ষ, ‘‘আগের রাজ্যপাল সম্পর্কেও তৃণমূলের মুখপত্রে বিজেপির লোক এবং আরও অনেক কিছু লেখা হয়েছিল। তার পরে সেই উপ-রাষ্ট্রপতি নির্বাচনে সেই ধনখড়েরই বিরোধিতা করেননি তৃণমূল নেত্রী। বিজেপি-তৃণমূলের সম্পর্কই এমন, মুখ্যমন্ত্রীকে না জিজ্ঞেস করে লিখে থাকলে পরে যে কোনও সময়ে ওঁরাই বিপদে পড়তে পারেন!’’
রাজ্যপাল বোসকে ঘিরে চাপানউতোর বাধলেও নিশীথ-কাণ্ডে কেন্দ্রীয় সরকার বা বিজেপির কেন্দ্রীয় নেতৃত্ব তেমন কোনও পদক্ষেপ এখনও করেনি। বিজেপির অন্দরের খবর, ‘ব্যক্তি নিশীথ’ সম্পর্কে দলেরই শীর্ষ নেতৃত্বের একাংশে ক্ষোভ রয়েছে। কেন্দ্রীয় নেতৃত্বের একাংশের বক্তব্য, নিশীথ নিজের সংসদীয় এলাকায় যথেষ্ট সময় দেন না। দলের নিচু তলার কর্মী থেকে সংবাদমাধ্যম— কারও সঙ্গেই ভাল সম্পর্ক নেই ওই রাজবংশী নেতার। বিজেপির এক কেন্দ্রীয় নেতার কথায়, ‘‘নিশীথ ধরে নিয়েছেন রাজবংশী আবেগ উস্কে ভোটে জিতবেন। ওই কৌশলে সব সময় সফল হবেন এমন কিন্তু নয়।’’
যদিও স্থানীয় তৃণমূল নেতৃত্বের একাংশ মনে করছে, নিশীথ এই ঘটনাটিকে ভাল ভাবেই নিজের প্রচারে লাগিয়েছেন। এ ক্ষেত্রে কী করা উচিত, তা নিয়ে কিছুটা ‘দ্বিধাবিভক্ত’ স্থানীয় তৃণমূল শিবির। দলের অন্দরের খবর, এক পক্ষ বলছেন— কেন্দ্রীয় প্রতিমন্ত্রীকে কালো পতাকা দেখানো ঘিরে গণ্ডগোলে প্রচার পেয়েছেন নিশীথই। অন্য পক্ষের দাবি, শুধু কেন্দ্রীয় বাহিনী নয়, অনুগামীদের নিয়ে তৈরি একটি বাহিনীর বিশাল কনভয় নিয়ে ঘোরাফেরা করেন নিশীথ। সেই ‘কনভয়’ রুখতে না পারলে লাভ হবে বিজেপিরই। তৃণমূলের এক নেতার কথায়, ‘‘কালো পতাকা বা বিক্ষোভ দেখিয়ে ওই অংশে হয়তো নিশীথকে আটকানো যাবে। কিন্তু তার যে প্রভাব গোটা রাজ্যে পড়বে, তা বিজেপির অনুকূলে যাবে।’’
এর মধ্যে নিশীথের কনভয়ে গণ্ডগোলের ঘটনায় বিজেপিরই ৪৮ জন নেতা-কর্মীর বিরুদ্ধে স্বতঃপ্রণোদিত মামলা দায়ের করেছে পুলিশ। ২১ জনকে গ্রেফতার করা হয়েছে। পুলিশের দাবি, ধৃতদের কয়েক জনের কাছ থেকে উদ্ধার হয়েছে আগ্নেয়াস্ত্রও। বাকিদের মধ্যে রয়েছেন জেলা বিজেপির একাধিক শীর্ষ নেতাও। বিজেপির অভিযোগ, পুলিশ রাজ্যের শাসক দলের নির্দেশ মেনে কাজ করছে। পুলিশের দাবি, দল দেখে নয়, যাঁরা গণ্ডগোলে জড়িত ছিলেন, তাঁদের চিহ্নিত করে গ্রেফতার করা হচ্ছে। প্রমাণও তাদের হাতে রয়েছে।