Artist Boycott Controversy

‘ভরকেন্দ্র’ বদলাচ্ছে তৃণমূলে, শিল্পী বয়কট তর্কে প্রকাশ‍্যে অভিষেক-বচন খণ্ডনে কুণাল-কল‍্যাণ-ব্রাত্য

অভিষেক প্রশ্ন তুলেছিলেন, দলের তরফে কোনও বিজ্ঞপ্তি জারি হয়েছিল কি না? শুক্রবার একাধিক গ্রুপে সেই সংক্রান্ত নির্দেশিকার হোয়াট্‌সঅ্যাপ স্ক্রিনশট প্রকাশ্যে এসেছে।

Advertisement

আনন্দবাজার অনলাইন সংবাদদাতা

শেষ আপডেট: ০৩ জানুয়ারি ২০২৫ ২০:০০
Share:

(বাঁ দিক থেকে) অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়, কুণাল ঘোষ, কল্যাণ বন্দ্যোপাধ্যায়, ব্রাত্য বসু। —ফাইল ছবি।

একদা ক্যামাক স্ট্রিটগামী নেতারা ক্রমশ কালীঘাটমুখী হচ্ছেন। ‘কালীঘাটপন্থী’ যে নেতারা মাঝে ক্যামাক স্ট্রিটের খুল্লমখুল্লা প্রশংসা করতেন, তাঁরা ফিরছেন পুরনো অবস্থানে। নতুন বছরের সবে তিন দিন কেটেছে। সমাপতন, কিন্তু বছর বদলের সঙ্গেই স্পষ্ট হয়ে যাচ্ছে শাসক তৃণমূলের অন্দরে ভরকেন্দ্র বদল। সৌজন্যে শিল্পীদের একাংশকে বয়কট করা সংক্রান্ত বিতর্ক।

Advertisement

আরজি কর পর্বে সরকার তথা মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সমালোচনা করা শিল্পীদের বয়কটের ডাক দিয়েছিলেন তৃণমূলের রাজ্য সম্পাদক কুণাল ঘোষ। বৃহস্পতিবার সেই প্রসঙ্গে দলের সর্বভারতীয় সাধারণ সম্পাদক অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায় স্পষ্ট করে দিয়েছিলেন, কুণালের বক্তব্য ‘দলের অবস্থান’ নয়। ২৪ ঘণ্টার মধ্যে দেখা গেল, কুণালের পাশে দাঁড়ালেন প্রবীণ তৃণমূল সাংসদ কল্যাণ বন্দ্যোপাধ্যায়। ‘কৌশলী’ মন্তব্য করেছেন শিক্ষামন্ত্রী ব্রাত্য বসু। যার মর্মার্থ— মমতার মতই তাঁর পথ।

পাশাপাশি, সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে শিল্পীচয়ন সংক্রান্ত বিভিন্ন স্তরে দলীয় বার্তার ‘প্রমাণ’ হিসাবে হোয়াট্‌সঅ্যাপ গ্রুপের একাধিক ‘স্ক্রিনশট’ প্রকাশ্যে এসেছে। যা নিয়ে নতুন করে শোরগোল শুরু হয়েছে তৃণমূলের অন্দরে। প্রসঙ্গক্রমে চলে এসেছে আরজি কর-কাণ্ডও। সেই পর্বে সরকার এবং শাসকদল যখন ‘কোণঠাসা’, তখন তৃণমূলের হয়ে যাঁরা সরব ছিলেন, তাঁদের মধ্যে কুণাল অন্যতম। কল্যাণও বিভিন্ন মন্তব্য করে কুণালের তালে তাল ঠুকেছিলেন। তা মনে করিয়ে দিয়ে শুক্রবার কল্যাণ বলেছেন, ‘‘আরজি কর পর্বে তো অনেককে কথাই বলতে দেখা যায়নি। যা বলার কুণাল বলত। আর আমি বলতাম।’’ তৃণমূলপন্থী জুনিয়র ডাক্তারদের প্রসঙ্গও টেনেছেন কল্যাণ। শ্রীরামপুরের সাংসদের কথায়, ‘‘আমাদের ছেলেদের ধরে ধরে সাসপেন্ড করেছিল। কুণাল ওদের পাশে দাঁড়িয়েছিল। আর আমি মামলা লড়েছি। তখন কেউ ছিল না।’’ শিল্পীদের একাংশকে বয়কটের আহ্বান প্রসঙ্গে অভিষেক আরজি করের প্রসঙ্গও তুলেছিলেন। ‘তাৎপর্যপূর্ণ’ ভাবে শুক্রবার আরজি কর পর্বের উল্লেখ করে কুণাল দলের সর্বভারতীয় সাধারণ সম্পাদকের সম্পর্কে বলেছেন, ‘‘অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায় ওই সময়টায় বাইরে ছিলেন।’’ কারণ নিয়ে বিতর্ক থাকলেও এটা ঠিক যে, আরজি কর আন্দোলন পর্বে অভিষেক সে ভাবে ‘সক্রিয়’ ছিলেন না। তিনি ‘সক্রিয়’ হয়েছিলেন শুধু ১৪ অগস্ট ‘মেয়েদের রাত দখল’ অভিযানের পরে রাতে আরজি করে ভাঙচুরের ঘটনায়। তৃণমূল ছাত্র পরিষদের প্রতিষ্ঠা দিবসের কর্মসূচিতে অভিষেক প্রকাশ্যেই ‘রাত দখল’ অভিযানকে শ্রদ্ধা জানিয়েছিলেন। অভিষেক ‘বাইরে ছিলেন’ বলে কুণাল শুক্রবার সেটাই মনে করিয়ে দিতে চেয়েছেন।

Advertisement

কুণালের বয়কটের ডাককে সমর্থন করে কল্যাণ জানিয়েছেন, তাঁর সংসদীয় এলাকায় দলের লোকেরা যে সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডে যুক্ত, সেখানে এমন কোনও শিল্পীকে তিনি ঢুকতে দেবেন না, যাঁরা আরজি কর পর্বে তৃণমূল তথা মুখ্যমন্ত্রী মমতার সমালোচনা করেছেন। কল্যাণের কথায়, ‘‘আমাদের সমস্ত আবেগ মমতাদিকে ঘিরে। তাঁকে যাঁরা অসম্মান করেছেন, সেই শিল্পীদের কেন ডাকতে যাব? আমার এলাকায় তো আমি ঢুকতে দেব না!’’ আবার শিক্ষামন্ত্রী ব্রাত্য বলেছেন, ‘‘দেখাই যাচ্ছে দলে দু’রকমের মত রয়েছে। আমাদের দল রেজিমেন্টেড নয়। অনেক খোলামেলা। তাই কেউ কারও কথা বলতেই পারেন।’’ সেই সঙ্গেই ব্রাত্যের সংযোজন, ‘‘দলে অভিষেকের স্থান আমার থেকে অনেক উঁচুতে। তাই অভিষেক ঠিক না কুণাল ঠিক, তা আমি বলতে পারব না। তবে দলের সদস্য হিসাবে বলতে পারি, মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের মতই আমার মত।’’ ব্রাত্য শুধু মন্ত্রী নন। তিনি নাট্যকার, অভিনেতা এবং পরিচালক। সেই ‘শিল্পীসত্তা’ থেকেও তিনি তাঁর অবস্থান জানিয়েছেন। তাঁর বক্তব্য, কেন্দ্রে নরেন্দ্র মোদী সরকার আসার পর থেকে তাঁর পরিচালিত দল কোনও অনুদান নেয়নি। যে শিল্পীরা সমালোচনা করেছিলেন, তাঁরা ঠিক করুন (রাজ্য সরকারের) অনুগ্রহ নেবেন কি না। ব্রাত্যের কথায়, ‘‘বিরোধিতাও করব আবার অনুদানের জন্য নাকে কাঁদব— দুটো একসঙ্গে হতে পারে না।’’

কিন্তু শিল্পী বয়কটের প্রশ্নে মমতার অভিমত কী? এ বিষয়ে তৃণমূলনেত্রীর কোনও মন্তব্য বা বিবৃতি এখনও প্রকাশ্যে আসেনি। তবে কল্যাণের মতো টানা চার বারের সাংসদ দলের সর্বময় নেত্রীর অনুমোদন ব্যতিরেকে এমন বলছেন, এ কথা তৃণমূলের কেউই প্রায় বিশ্বাস করছেন না। বৃহস্পতিবার অভিষেকের বক্তব্যের পাল্টা কুণাল বলেছিলেন, ‘‘মমতাদি বলে দিন, আমি ভুল বলছি। মেনে নেব।’’ শুক্রবার পর্যন্ত মমতা বলেননি, কুণাল ‘ভুল’ বলেছেন। যে দিন ব্রাত্য বললেন, মমতার মতামতই তাঁর মত।

ঘটনাচক্রে, ঠিক এক বছর আগে অভিষেকের ‘নবীন’ তত্ত্বের পক্ষে দাঁড়িয়ে প্রবীণদের বিঁধেছিলেন কুণাল। কথায় কথায় তিনি বলতেন, ‘‘মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় আমার নেত্রী। অভিষেক আমার সেনাপতি।’’ সেই তিনি শেষ কবে অভিষেককে ‘সেনাপতি’ বলে উল্লেখ করেছেন, তা অনেকেই মনে করতে পারছেন না। ব্রাত্যও অভিষেকের ‘ঘনিষ্ঠ’ বলেই পরিচিত ছিলেন। ২০২৩ সালের শেষ দিকে অভিষেক যখন সংগঠন থেকে নিজেকে গুটিয়ে রেখেছিলেন, নিজেকে ডায়মন্ড হারবারের মধ্যে ‘সীমাবদ্ধ’ রেখেছিলেন, তখন যে কয়েক জন নেতা তাঁকে বোঝাতে দৌত্য চালিয়েছিলেন, তাঁদের মধ্যে ব্রাত্য এবং কুণাল ছিলেন অন্যতম। একটা সময়ে অভিষেকের বিমানে তাঁর সফরসঙ্গী হয়েছিলেন ব্রাত্য। আবার কল্যাণ একটা সময়ে অভিষেককে ‘অপছন্দ’ করলেও পরে তাঁর ঢালাও প্রশংসাও করেছেন। সেই তিনিও শিল্পী বয়কট বিতর্কে অভিষেকের বক্তব্যকে খণ্ডন করে কুণালের পাশে দাঁড়িয়েছেন।

সেই সূত্রেই শাসক শিবিরে ক্ষমতার ‘ভরকেন্দ্র’ বদল নিয়ে আলোচনা আরও জোরালো হয়েছে। কুণাল, কল্যাণ এবং ব্রাত্যকে তার ‘সূচক’ বলে মনে করা হচ্ছে।

২০২১ সালের বিধানসভা ভোটের পরেই অভিষেককে দলের সর্বভারতীয় সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্ব দিয়েছিলেন তৃণমূলের সর্বময় নেত্রী মমতা। তার পরে অভিষেক বর্ণিত ‘এক ব্যক্তি এক পদ’, ‘রাজনীতিতে অবসরের ঊর্ধ্বসীমা’-সহ একাধিক তত্ত্ব নিয়ে তৃণমূল আলোড়িত হয়েছে। প্রবীণ নেতাদের অনেকেই প্রকাশ্যে অভিষেকের তত্ত্বের উল্টো মতামত জানাতেন। সেই সময়ে অভিষেকের তত্ত্বকে প্রতিষ্ঠিত করতে ব্যাট ধরতেন কুণাল। এই সব ঘটনাপ্রবাহে কোন নেতা কোন ঘাটে তরী বেঁধেছেন, তা নিয়ে স্পষ্ট ধারণা ছিল তৃণমূলের অন্দরে। কিন্তু সাম্প্রতিক সময়ে তাতে বদল হয়েছে। শিল্পী বয়কট বিতর্ক যা প্রকট করে দিয়েছে। তবে দলের প্রবীণ নেতাদের একাংশ বলছেন, ‘‘তৃণমূলে চিরকাল একটাই ভরকেন্দ্র। সেই ভরকেন্দ্রের নিউক্লিয়াসের নাম মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। বাকি সকলেই তাঁর আলোয় আলোকিত।’’

বৃহস্পতিবার অভিষেক প্রশ্ন তুলেছিলেন, শিল্পীদের বয়কট করার প্রসঙ্গে দলের তরফে কোনও বিজ্ঞপ্তি জারি হয়েছিল কি না? শুক্রবার একাধিক গ্রুপে সেই সংক্রান্ত নির্দেশিকার হোয়াটস্‌অ্যাপ স্ক্রিনশট প্রকাশ্যে এসেছে। যেখানে লেখা রয়েছে, সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে শিল্পী বাছাইয়ের ক্ষেত্রে মন্ত্রী ইন্দ্রনীল সেনের সঙ্গে কথা বলে নিতে হবে। সঙ্গে ইন্দ্রনীলের হোয়াটস্‌অ্যাপ নম্বরও রয়েছে। যাকে দলীয় স্তরের ‘নির্দেশ’ হিসাবেই দেখাতে চাইছে কুণাল শিবির। উত্তর কলকাতার একটি গ্রুপে এক কাউন্সিলর সেই বার্তা দিয়েছেন। আবার একই বার্তা এসেছে অন্য একটি গ্রুপে অন্য একটি নম্বর থেকে। সেই নম্বর ‘সেভ’ করা রয়েছে এক জনের নামে। পাশে পরিচয়, ‘পিএস ববিদা’। যা দেখে অনেকের অনুমান, এই উদ্যোগের নেপথ্যে পুরমন্ত্রী তথা কলকাতার মেয়র ফিরহাদ হাকিমও রয়েছেন। প্রথমত, যিনি কালীঘাটের ‘আস্থাভাজন’ হিসাবে পরিচিত। দ্বিতীয়ত, যাঁর সঙ্গে অভিষেকের সম্পর্ক ‘মসৃণ’ নয়।

দলের অন্দরে অভিষেকের উত্থান, সাধারণ সম্পাদক হিসেবে তাঁর সংগঠন পরিচালনার ধরন বা প্রক্রিয়া নিয়ে তৃণমূলের অন্দরে মাঝেমধ্যে বিতর্ক তৈরি হয়েছে। জল্পনা তৈরি হয়েছে তাঁর সঙ্গে মমতার দল পরিচলনার ‘পদ্ধতিগত ফারাক’ নিয়েও। কিন্তু প্রকাশ্যে অভিষেকের বক্তব্যকে চ্যালেঞ্জ করা বা খণ্ডন করার ঘটনা এর আগে ঘটেনি। বিশেষত তাঁদের তরফে, যাঁদের মধ্যে অন্তত দু’জন তাঁকে ‘ক্যাপ্টেন’ বলে সম্বোধন করতেন।

নতুন বছরে রোহিত শর্মা একাই দলের মধ্যে চ্যালেঞ্জের মুখে পড়েননি!

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement