Arabul Islam

লোকসভা ভোট মিটতেই আরাবুলকে পঞ্চায়েত সমিতির সভাপতি পদ থেকেও সরিয়ে দিল তৃণমূল

চার মাস ধরে জেলবন্দি তৃণমূলের ‘তাজা’ নেতা। বৃহস্পতিবার আচমকাই ভাঙড়ের বিজয়গঞ্জ বাজারে জরুরি ভিত্তিতে বৈঠক ডাকেন ক্যানিং পূর্ব তৃণমূল বিধায়ক শওকত মোল্লা। সেই বৈঠকেই সিদ্ধান্তের কথা জানিয়ে দেন তিনি।

Advertisement

আনন্দবাজার অনলাইন সংবাদদাতা

কলকাতা শেষ আপডেট: ০৯ জুন ২০২৪ ১২:১২
Share:

আরাবুল ইসলাম। ছবি: ফেসবুক।

লোকসভা ভোট পর্ব শেষ হতেই ভাঙড়-২ পঞ্চায়েত সমিতির সভাপতি পদ থেকে আরাবুল ইসলামকে সরিয়ে দিল তৃণমূল। দীর্ঘ চার মাস ধরে জেলবন্দি তৃণমূলের এই ‘তাজা’ নেতা। মঙ্গলবার ভোটের ফলাফল প্রকাশের পর বৃহস্পতিবার আচমকাই ভাঙড়ের বিজয়গঞ্জ বাজারে জরুরি ভিত্তিতে বৈঠক ডাকেন ক্যানিং পূর্ব তৃণমূল বিধায়ক শওকত মোল্লা। সেই বৈঠকেই দলীয় সিদ্ধান্তের কথা স্থানীয় নেতৃত্বকে জানিয়ে দেন তিনি। বৈঠকে তিনি বলেন, পঞ্চায়েত সমিতির সভাপতি দীর্ঘ দিন না থাকায় কাজকর্মে অসুবিধা হচ্ছে। তাই তাঁর বদলে পঞ্চায়েত সমিতির সহ-সভাপতি সোনালি বাছাড়কে সভাপতির দায়িত্ব দেওয়া হচ্ছে। সহ-সভাপতির দায়িত্ব সামলাবেন তিনি। সূত্রের খবর, জেল থেকে ছাড়া পেলেও আরাবুলকে পঞ্চায়েত সমিতির সভাপতি পদে ফেরানো হবে কি না, সে বিষয়ে স্পষ্ট কোনও কথা জানাননি শওকত।

Advertisement

২০২৩ সালের পঞ্চায়েত নির্বাচনে জয়ী হয়ে ভাঙড় দুই ব্লক পঞ্চায়েত সমিতির সভাপতি হন আরাবুল। কিন্তু চলতি বছর ৮ ফেব্রুয়ারি তোলাবাজির অভিযোগে ঘটনায় তাঁকে গ্রেফতার করে কলকাতা পুলিশ। সেই থেকেই জেলবন্দি তিনি। এ বার তাঁর অনুপস্থিতিতে পঞ্চায়েত সমিতির সভাপতি পদ থেকে সরিয়ে দেওয়া হল তাঁকে। দলগত ভাবে আরাবুলের এখন আর দলের কোনও পদে নেই। কারণ, গত বছর পঞ্চায়েত নির্বাচনের আগে ভাঙড় বিধানসভার ‘আহ্বায়ক’ পদ দেওয়া হয়েছিল আরাবুলকে। সেই পদ থেকে এপ্রিল মাসে তাঁকে সরিয়ে দেওয়া হয়। ওই পদ থেকে সরিয়ে দেওয়ার পরে আরাবুল দলের আর কোনও সাংগঠনিক বা প্রশাসনিক দায়িত্বে নেই। এখন তিনি শুধু তৃণমূলের একজন কর্মী। ভাঙড়ে প্রশ্ন উঠতে শুরু করেছে, তৃণমূলে ‘আরাবুল জমানা’ কি শেষ?

আরাবুলকে সাংগঠনিক এবং প্রশাসনিক পদ থেকে সরিয়ে দেওয়ার সিদ্ধান্ত প্রসঙ্গে তৃণমূলের একটি সূত্র জানিয়েছে, কলকাতা পুলিশের বিরুদ্ধে ‘অসহযোগিতার’ অভিযোগ তুলে স্ত্রীর মাধ্যমে কলকাতা হাই কোর্টের দ্বারস্থ হয়েছিলেন আরাবুল। তাঁর স্ত্রী জাহানারা বিবি অভিযোগ করেছেন, স্বামীর বিরুদ্ধে মোট ১৩টি মামলা রয়েছে বলে তাঁরা অবগত। এর বাইরে তাঁর বিরুদ্ধে আর কোনও মামলা রয়েছে কি না, তা জানতে চাইলেও কলকাতা পুলিশ তাঁদের সেই তথ্য দিচ্ছে না। শাসকদলের নেতার স্ত্রীর এমন অভিযোগে ‘অস্বস্তিতে’ পড়েছিল কলকাতা পুলিশ। বিচারপতি জয় সেনগুপ্তের এজলাসে ওই মামলার শুনানিতে আরাবুলের আইনজীবী ফিরোজ এডুলজি দাবি করেছিলেন, পুলিশি হেফাজতে রেখেই একের পর এক মামলায় যুক্ত করা হচ্ছে আরাবুলকে। তার পরেই ভাঙড়ের আহ্বায়ক পদ থেকে আরাবুলকে সরিয়ে দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। এ বার তাঁকে সরিয়ে দেওয়া হল পঞ্চায়েত সমিতির সভাপতি পদ থেকে।

Advertisement

উল্লেখ্য, ২০০৪ সালের লোকসভা নির্বাচনে ভাঙড় ছিল বসিরহাট লোকসভার অন্তর্গত। সেই ভোটে তৃণমূল প্রার্থী সুজিত বসু ভাঙড় থেকে ৫২ হাজারের বেশি ভোটে পিছিয়ে গিয়েছিলেন। ২০০৬ সালের বিধানসভা নির্বাচনে ভাঙড় আসনে তৃণমূলের টিকিটে জিতেছিলেন আরাবুল। সেই ভোটে বামফ্রন্টের ২৩৫ আসন জয়ের মধ্যেও ভাঙড়ে আরাবুলের জয় তৃণমূলের কাছে ছিল বড় প্রাপ্তি। সেই থেকেই রাজ্য রাজনীতিতে আলোচনায় উঠে আসেন আরাবুল। দক্ষিণ ২৪ পরগনা জেলা সিপিএম নেতৃত্বের সঙ্গে আরাবুলের গোষ্ঠীর সংঘর্ষের খবর প্রকাশ্যে আসতে শুরু করে। তৎকালীন বামফ্রন্ট মন্ত্রিসভার ভূমি ও ভূমিরাজস্ব মন্ত্রী আব্দুর রেজ্জাক মোল্লার গোষ্ঠীর সঙ্গে আরাবুলের গোষ্ঠীর বিবাদ ছিল তখন ভাঙড়ের রাজনীতির নিত্যনৈমিত্তিক ঘটনা। বর্তমানে ক্যানিং পূর্বের তৃণমূল বিধায়ক তথা ভাঙড়ের দায়িত্বপ্রাপ্ত নেতা শওকত তখন আরাবুলের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে রেজ্জাকের পাশেই ছিলেন। তখন থেকেই ভাঙড়ে ‘আরাবুল জমানা’র সূত্রপাত। অধুনা জেলবন্দি নেতা পার্থ চট্টোপাধ্যায় আরাবুলকে ‘ভাঙড়ের তাজা নেতা’ বলে আখ্যা দেওয়ার পরে দলের অন্দরে ভাঙড়ের বিধায়কের ‘প্রতাপ’ আরও বৃদ্ধি পায়। কিন্তু সিপিএমের বিরুদ্ধে লড়াইয়ের পাশাপাশি নিজের দলের মধ্যেও অন্তর্দ্বন্দ্বে জড়িয়ে পড়েছিলেন আরাবুল। সেই ঘটনার জেরে ২০১১ সালের বিধানসভা ভোটে রাজ্য জুড়ে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের জয়জয়কার হয়ে রাজ্যে পালাবদল হলেও ভাঙড়ে পরাজিত হন আরাবুল। অধুনাপ্রয়াত তৃণমূল নেতা নন্নু হোসেন ভাঙড়ে নির্দল প্রার্থী হিসাবে লড়াই করায় হেরে যেতে হয় আরাবুলকে। জয়ী হন সিপিএমের বাদল জমাদার।

এর পরে ২০১৫ সালে দলবিরোধী কার্যকলাপের জেরে ছ’বছরের জন্য তৃণমূল থেকে সাসপেন্ড করা হয় ‘তাজা নেতা’কে। যদিও মাস আটেকের মধ্যেই দক্ষিণ ২৪ পরগনা জেলা তৃণমূলের তৎকালীন সভাপতি শোভন চট্টোপাধ্যায়ের উদ্যোগে তাঁকে দলে ফিরিয়ে নেওয়া হয়েছিল। কিন্তু ২০১৬ সালের বিধানসভা নির্বাচনে জোড়া ধাক্কা খান আরাবুল। যে রেজ্জাকের সঙ্গে লড়াই করে তাঁর রাজনৈতিক উত্থান, ভাঙড় বিধানসভায় তাঁকেই প্রার্থী করে দেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। মুখ বুজে তা মেনে নেওয়া ছাড়া আরাবুলের উপায় ছিল না। একই সঙ্গে দলের অন্দরে তাঁর ‘প্রবল প্রতিপক্ষ’ শওকতকে ক্যানিং পূর্ব আসন থেকে টিকিট দেয় তৃণমূল। রেজ্জাক-শওকত দু’জনেই জেতেন। আর ভাঙড়ের রাজনীতিতে ক্রমশ তলিয়ে যেতে থাকেন আরাবুল। পঞ্চায়েত ভোটে জিতে পঞ্চায়েত সমিতির সভাপতি হলেও তাঁর আর আগের মতো দাপট ছিল না। কারণ, তত দিনে ভাঙড় তৃণমূলের সাংগঠনিক দায়িত্ব চলে গিয়েছে শওকতের হাতে। ২০২১ সালের বিধানসভা নির্বাচনে গোষ্ঠীদ্বন্দ্ব এড়াতে স্থানীয় নেতাদের বাদ দিয়ে চিকিৎসক রেজাউল করিমকে ভাঙড়ে প্রার্থী করেছিল তৃণমূল। কিন্তু সংযুক্ত মোর্চার প্রার্থী আইএসএফ নেতা নওশাদ সিদ্দিকি সেখানে জিতে যান। বিজেপি ছাড়া সারা রাজ্যে ওই একটি আসনেই জিতেছিল বিরোধী পক্ষ। ওই হারে আরাবুলের বিরুদ্ধেই ‘অন্তর্ঘাতের’ অভিযোগ তুলেছিল তৃণমূলের একাংশ। পরে পঞ্চায়েত ভোটে তাঁকে ‘আহ্বায়ক’ পদ দেওয়া হলেও চাবিকাঠি ছিল শওকতের হাতেই। এখন সেই পদ-সহ পঞ্চায়েত সমিতির সভাপতি পদ থেকে তাঁকে সরিয়ে দেওয়া হল। যা জেনে ভাঙড়ের আরাবুল-অনুগামীরা বলছেন, ‘‘আরাবুলদার পাশে দাঁড়াতে পারেন, এমন কোনও নেতা বোধ হয় আর তৃণমূলে নেই। দাদা জেল থেকে মুক্তি পেয়ে ভাঙড়ে ফিরলেও, তৃণমূলে রাজনীতি করার পরিসর পাবেন কি না, তা নিয়ে হাজারো প্রশ্ন রয়েছে।”

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement