(বাঁ দিকে) আরাবুল ইসলাম। (ডান দিকে) হাকিমুল ইসলাম। — ফাইল চিত্র।
ক্ষমা চাইলেন। একই সঙ্গে ভুলও স্বীকার করলেন ভাঙড়ের ‘তাজা নেতা’ আরাবুল ইসলামের পুত্র হাকিমুল ইসলাম। পাশাপাশি, মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে দেখেই পঞ্চায়েতে তৃণমূলকে ভোট দেওয়ার আবেদন জানিয়েছেন তিনি। বৃহস্পতিবার আরাবুল-পুত্র বলেন, ‘‘যদি তৃণমূল কংগ্রেসের কোনও কর্মী ভুল করে থাকে, আপনাদের কাছে ক্ষমা চেয়ে নিচ্ছি। আমরা ভুল স্বীকার করছি। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে দেখে আমাদের ভোট দিন।’’ পুত্রের এ হেন ‘ক্ষমা চাওয়া’ ও ‘ভুল স্বীকার’-এর পরে ভাঙড় তৃণমূলের একদা দোর্দ্দণ্ডপ্রতাপ নেতা আরাবুলের ‘দাপট’ নিয়ে প্রশ্ন উঠছে। তবে কি ভাঙড়ের রাজনীতিতে কোণঠাসা হয়ে পড়েছেন আরাবুল?
যদিও ভাঙড়ের রাজনীতি নিয়ে ওয়াকিবহাল মহল মনে করেন, দলে অনেক দিন ধরেই আরাবুল কোণঠাসা। ২০০৬ সালের বিধানসভা নির্বাচনে বামফ্রন্টের ঝড়ের সামনে তৃণমূলের যে ৩০ জন বিধায়ক জয়ী হয়েছিলেন, তাঁদের এক জন ছিলেন আরাবুল। সেই সময় সিপিএমের সঙ্গে সমানে সমানে টক্কর দিতেন তিনি। ২০১১ সালে রাজ্যে পালাবদলের পর ভাঙড় কলেজের এক অধ্যাপিকাকে জলের জগ ছুঁড়ে মেরেছিলেন আরাবুল। তার পরেও রাজ্য রাজনীতি তাঁর দাপট দেখেছে। কিন্তু সেই আরাবুলকেই ২০২৩ সালের পঞ্চায়েত ভোটের সময়ে এসে তাঁর অনুগামীদেরই আলাদা ঠেকছে। এই আরাবুলকে এক সময় বর্তমানে কামারহাটির বিধায়ক মদন মিত্র ‘তাজা নেতা’ বলে অভিহিত করেছিলেন। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক ভাঙড়ের এক তৃণমূল নেতার কথায়, ‘‘২০০৬ সালের আরাবুল ও ২০২৩ সালের আরাবুলকে এক করে দেখলে ভুল হবে। ক্ষমতায় আসার পর দলীয় রাজনীতিতে যে ভাবে তাঁর অবনমন হয়েছে, তাতে এখন আর আরাবুলকে ভাঙড় তৃণমূলের একচ্ছত্র নেতা বলা চলে না।’’
২০১১ সালে গোটা রাজ্যে পরিবর্তনের ঝড় বইলেও ভাঙড়ে সিপিএম নেতা বাদল জামাদারের কাছে পরাজিত হন আরাবুল। সেই থেকেই ভাঙড়ের রাজনীতিতে ‘স্খলন’ শুরু তাঁর। যদিও ২০১৩ সালের পঞ্চায়েত নির্বাচনের পর ভাঙড়-২ পঞ্চায়েত সমিতির সভাপতি হন তিনি। ওই বছরই পোলেরহাট-২ পঞ্চায়েতে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় জিতে প্রধান হন তাঁর পুত্র হাকিমুল। কিন্তু, বছর দুয়েকের মধ্যেই, ২০১৫ সালে গোষ্ঠীদ্বন্দ্বের জেরে তৃণমূল থেকে ৬ বছরের জন্য সাসপেন্ড করা হয় আরাবুলকে। ২০১৬ সালের ভোটের আগে তাঁর সাসপেনশন তুলে নেন দক্ষিণ ২৪ পরগনা জেলা তৃণমূলের তৎকালীন সভাপতি শোভন চট্টোপাধ্যায়। তবে সাসপেনশন উঠে গেলে, সে ভাবে আর নিজেকে মেলে ধরতে পারেননি আরাবুল। ২০১৬ সালে সিপিএম নেতা রেজ্জাক মোল্লা তৃণমূলে যোগ দিলে তাঁকেই ভাঙড় থেকে প্রার্থী করেন দলনেত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। দলের একাংশের দাবি, সেই সময় এই সিদ্ধান্ত মন থেকে মেনে নিতে পারেননি আরাবুল। কারণ, রেজ্জাক সিপিএমে থাকার সময় থেকেই আরাবুলের সঙ্গে তাঁর সম্পর্ক খারাপ ছিল। তা সত্ত্বেও দলীয় সিদ্ধান্ত মেনে নিতে হয় আরাবুলকে। দলের অন্দরে কান পাতলে সেই সময় শোনা যেত, ভাঙড়ে তৃণমূলের গোষ্ঠী কোন্দল চাপা দিতেই রেজ্জাককে প্রার্থী করেছিলেন মমতা। বড় ব্যবধানে জয় পান রেজ্জাক। তাঁকে নিজের মন্ত্রিসভায় জায়গাও দেন মমতা। যা ছিল রাজনীতিক আরাবুলের কাছে ‘জোর ধাক্কা’।
এর পর নানা সময়ে ভাঙড়ের রাজনীতিতে আরাবুলের সঙ্গে বিধায়ক রেজ্জাকের সংঘাতের খবর প্রকাশ্যে এসেছে। সঙ্গে আরাবুল-বিরোধী নেতা-কর্মীরাও রেজ্জাক শিবিরে যোগ দেন। ২০২১ সালের বিধানসভা ভোটে ভাঙড় থেকে চিকিৎসক রেজাউল করিমকে প্রার্থী করে তৃণমূল। তবে তৃণমূলের ওই প্রার্থীকে হারিয়ে জয় পান ইন্ডিয়ান সেকুলার ফ্রন্ট (আইএসএফ)-এর চেয়ারম্যান নওশাদ সিদ্দিকি। ভাঙড়ে দলীয় প্রার্থী রেজাউলের হারে আরাবুলকেই দায়ী করেছিলের দলের শীর্ষ নেতৃত্ব।
বর্তমানে ভাঙড় থেকে আইএসএফের প্রভাব কমাতে তৃণমূল নেতৃত্ব দায়িত্বে দিয়েছেন ক্যানিং পূর্বের বিধায়ক শওকত মোল্লাকে। সম্প্রতি আবার শওকতকে সহযোগিতা করতে বিধাননগরের চেয়ারম্যান সব্যসাচী দত্তকেও আনা হয়েছে। ফলে ভাঙড়ের রাজনীতিতে যে আরাবুল ও তাঁর পরিবারের গুরুত্ব অনেকটাই কমেছে তা দিনের আলোর মতো স্পষ্ট। ঘটনাচক্রে এ বারের পঞ্চায়েত ভোটে ভাঙড়-২ ব্লক থেকে জেলা পরিষদের প্রার্থী হয়েছেন হাকিমুল। আরাবুলের শক্ত ঘাঁটি বলে পরিচিত ভাঙড়ের বামনঘাটা এলাকা। সেখানে দাঁড়িয়ে বৃহস্পতিবার ‘নরম সুরে’ আরাবুল-পুত্র বলেন, ‘‘যদি তৃণমূল কংগ্রেসের কোনও কর্মী ভুল করে থাকে, আপনাদের কাছে ক্ষমা চেয়ে নিচ্ছি। আমরা ভুল স্বীকার করছি। আপনারা আমাদের ভোট দিন। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে দেখে ভোট দিন। আমাদের ভুল থাকলে ক্ষমা করে দিন। আগামী পাঁচ বছরের জন্য ভোটটাকে ঋণ হিসাবে চাইছি।”
হাকিমুলের বিরুদ্ধে দাঁড়িয়েছেন আইএসএফের এক প্রার্থী। আরাবুল-ঘনিষ্ঠদের দাবি, বিষয়টি নিয়ে চিন্তায় রয়েছেন তিনি। সে কারণেই পুত্র হাকিমুলকে কিছুটা নরম সুরেই প্রচার করার পরামর্শ দিয়েছেন আরাবুল। ভাঙড়ে তৃণমূলের প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বী যে আইএসএফ, তা এক বাক্যে মানছেন দক্ষিণ ২৪ পরগনা জেলা তৃণমূলের নেতারাও। সেই লড়াইয়ের আঁচ পেয়েই হাকিমুলের এত ‘নরম সুর’ বলে মনে করছেন দলেরও একাংশ।
যদিও হাকিমুলের এই ‘সুর নরম’কে ‘নাটক’ বলে আক্রমণ করেছেন ভাঙড়ের আইএসএফ বিধায়ক নওশাদ। তাঁর কথায়, ‘‘ভাঙড়ের মানুষ এদের অত্যাচারে অতিষ্ঠ। তার প্রমাণ আমরা পেলাম পঞ্চায়েত ভোটের মনোনয়নের সময়। এরা বাইরে থেকে গুন্ডা বদমাইশ এনে কাউকে ৫ হাজার, কাউকে ১০ হাজার টাকা দিয়ে আইএসএফ কর্মীদের উপর চড়াও হতে বলেছে। এদের আতঙ্কে ভাঙড়ের মানুষ আতঙ্কিত। তাই ভাঙড়ের মানুষ এদের প্রত্যাখান করতে শুরু করেছে। হাকিমুল সাহেব ও আরাবুল সাহেবের পায়ের নীচে মাটি নেই।’’
সিপিএম নেতা সুজন চক্রবর্তী আরও এক ধাপ এগিয়ে কটাক্ষ করেছেন আরাবুলদের। তাঁর কথায়, ‘‘তৃণমূলের নেত্রী যে মা-মাটি-মানুষের কথা বলেন, তার কোনওটাই আর ওদের সঙ্গে নেই। ফলে আরাবুল আর পায়ের নীচে মাটি পাবেন কোথা থেকে!’’