অমিত শাহের সভার পরের দিনই রাজ্যের একাধিক জায়গায় সিবিআই তল্লাশি চলছে। গ্রাফিক: শৌভিক দেবনাথ।
নয়াদিল্লির কৃষ্ণ মেনন মার্গের বাসভবনে অমিত শাহ পৌঁছানোর ১২ ঘণ্টা কাটতে না কাটতেই রাজ্য জুড়ে সিবিআই অভিযান। একই সঙ্গে কলকাতা, নিউটাউন-সহ মুর্শিদাবাদের একাধিক জায়গায় তল্লাশি অভিযান শুরু করেছে কেন্দ্রীয় গোয়েন্দা সংস্থা। যাঁদের বাড়িতে কেন্দ্রীয় তদন্তকারী সংস্থা গিয়েছে, তাঁরা সকলেই তৃণমূলের নেতা, জনপ্রতিনিধি বা কোনও না কোনও নেতার ‘ঘনিষ্ঠ’। যা দেখে তৃণমূলের অভিযোগ, বুধবারে ধর্মতলায় কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর সভা ‘সফল’ করতে না পারার ‘খামতি’ ঢাকতেই সিবিআইয়ের এই তৎপরতা।
রাজ্যের শাসকদল মনে করছে, বুধবার শাহ রাজ্য বিজেপিকে এবং রাজ্য বিজেপি শাহকে যে ভাবে হতাশ করেছে, তা নিয়ে বৃহস্পতিবারেও সমাজমাধ্যম বা জনমানসে যে আলোচনা চলার কথা ছিল, তার স্রোত ঘুরিয়ে দিতেই এই তল্লাশি। যা আসলে ‘রাজনৈতিক’। প্রত্যাশিত ভাবেই বিজেপি যে অভিযোগ উড়িয়ে দিয়ে দাবি করছে, তৃণমূল নিজের মতো করে ভাবে বলেই ‘স্বাধীন তদন্তে’ রাজনীতি দেখছে!
বুধবার ধর্মতলায় ভিক্টোরিয়া হাউসের সামনে জনসভা করেছেন শাহ। যেখানে ফি-বছর মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের নেতৃত্বে তৃণমূলের ‘শহিদ দিবস’ কর্মসূচি দীর্ঘকাল ধরে হয়ে আসছে। রাজ্য বিজেপি সেখানেই সভা করার গোঁ ধরেছিল। প্রশাসনিক অনুমতি না পেলেও আদালতে গিয়ে অনুমতি পেয়ে সভা করে তারা। স্বাভাবিক ভাবেই সেই সভার সঙ্গে তৃণমূলের ২১ জুলাই সমাবেশের তুলনা এসে গিয়েছিল। সাদা চোখেই দুইয়ের মধ্যে বিস্তর ফারাক চোখে পড়েছে। ভিড়ের বহর, বক্তৃতা, স্বতঃস্ফূর্ততা ইত্যাদি বিবিধ বিষয়ে যে বিজেপির সভা মমতার বার্ষিক সভার ধারেপাশে পৌঁছতে পারেনি, তা একান্ত আলোচনায় স্বীকার করে নিয়েছেন অনেক বিজেপি নেতাই। যদিও প্রকাশ্যে সকলেই সভার ‘সাফল্যে’ উচ্ছ্বসিত। তবে শাহ কলকাতায় এসে তৃণমূলের বিরুদ্ধে যতটা ‘আক্রমণাত্মক’ বার্তা দেবেন বলে বিজেপির নেতা থেকে সাধারণ কর্মীরা আশা করেছিলেন, তা হয়নি। বিভিন্ন অভিযোগে কেন্দ্রীয় তদন্তের বিষয়ে একটি শব্দও খরচ করেননি শাহ। জেলে থাকা পার্থ চট্টোপাধ্যায়, অনুব্রত মণ্ডল, জ্যোতিপ্রিয় মল্লিকদের বহিষ্কার করার চ্যালেঞ্জ মমতার উদ্দেশে ছুড়লেও আগামিদিনে তদন্তের বিষয়ে কিছু বলেননি। অথচ সেটাই শুনতে জড়ো হয়েছিলেন বিজেপির কর্মী-সমর্থকরা। এই পারস্পরিক হতাশার কথা বুধবার বিকেল থেকেই আলোচনায় ছিল। যেমন ছিল তৃণমূলের তরফে কড়া কটাক্ষও।
সন্ধ্যা নামার আগেই শাহ কলকাতা ছেড়ে দিল্লি উড়ে যান। আর বৃহস্পতিবার সকাল থেকে দেখা যায় ‘তৎপর’ হয়েছে সিবিআই। হানা এবং তল্লাশি শুরু হয়েছে রাজ্যের বিভিন্ন এলাকায়। সেগুলি আবার একই অভিযোগের তদন্তে নয়। এক দিকে যেমন রাজ্যের প্রাক্তন মন্ত্রী পার্থের ‘ঘনিষ্ঠ’ তৃণমূল কাউন্সিলর বাপ্পাদিত্য দাশগুপ্তের বাড়িতে হানা দেয় সিবিআই, তেমনই তারা পৌঁছে যায় বিধাননগর পুরসভার তৃণমূল কাউন্সিলর দেবরাজ চক্রবর্তীর বাড়িতেও। ওই দুই তৃণমূল নেতার বাড়িতে তল্লাশির খবরের মধ্যেই জানা যায়, মুর্শিদাবাদের একাধিক জায়গাতেও হানা দিয়েছে সিবিআই। ডোমকলের তৃণমূল বিধায়ক জাফিকুল ইসলামের বাড়ির পাশাপাশি জেলায় মোট চার জায়গায় সিবিআই তল্লাশি শুরু করেছে ভোর থেকে। পাশাপাশি, মুর্শিদাবাদের বড়ঞার কুলিতে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ব্যবসায়ী ঝন্টু শেখের বাড়িতেও তল্লাশি অভিযান চলছে।
ঘটনাপরম্পরা দেখে তৃণমূলের রাজ্য সাধারণ সম্পাদক তথা মুখপাত্র কুণাল ঘোষ বলেছেন, ‘‘বুধবার বিজেপির সভায় লোক হয়নি। অমিত শাহের বক্তৃতাও ছিল সুপার ফ্লপ। সেই দৈন্যদশা ঢাকতে সকাল থেকে সিবিআইকে নামিয়ে দিয়েছে!’’ যদিও বিজেপি সে দাবি উড়িয়ে দিয়েছে। বুধবার সভার শেষে মঞ্চের পিছনে দলের রাজ্য সভাপতি সুকান্ত মজুমদার এবং বিরোধী দলনেতা শুভেন্দু অধিকারীর সঙ্গে কিছুটা সময় কাটান শাহ। তার আগে রেস কোর্সের হেলিপ্যাড থেকে রাজ্য বিজেপির এই দুই প্রধান নেতাই শাহকে নিয়ে আসেন এবং সভা শেষে রেসকোর্স হেলিপ্যাডে পৌঁছে দেন। মঞ্চে শাহ চুপ থাকলেও মঞ্চের পিছনে কি তাঁর সঙ্গে বিভিন্ন অভিযোগের তদন্তের অগ্রগতি বা ভবিষ্যৎ নিয়ে রাজ্যের শীর্ষনেতাদের কোনও আলোচনা হয়েছিল? তার ফলেই কি বৃহস্পতির অভিযান? সে প্রশ্ন যেমন রাজ্যের শাসকদলের, তেমনই অন্যান্য দলের রাজনীতির কারবারিদেরও। যদিও একটি সূত্র জানাচ্ছে, বাপ্পাদিত্য এবং দেবরাজের বাড়িতে সিবিআই তল্লাশি হবে বলে দিনদুয়েক আগে থেকেই শোনা যাচ্ছিল। ফলে এর সঙ্গে অমিত-সভার কোনও যোগসূত্র নেই।
তৃণমূলের অভিযোগ শুনে বিজেপির রাজ্য মুখপাত্র শমীক ভট্টাচার্য দাবি করেছেন, ‘‘তৃণমূল নিজেদের সঙ্গে বিজেপিকে গুলিয়ে ফেলছে! ওরা যেমন রাজনৈতিক ভাবে সিআইডিকে ব্যবহার করে, তেমনটা বিজেপি করে না।’’ বুধবারের সমাবেশ আদৌ ‘ব্যর্থ’ নয় বলে দাবি করে শমীক আরও বলেন, ‘‘এই তল্লাশির সঙ্গে শাহের সফরের কোনও যোগাযোগ নেই। এটা নরেন্দ্র মোদী সরকারের দুর্নীতির প্রতি জ়িরো টলারেন্স নীতিরই প্রকাশ। আর সব তদন্তই হচ্ছে আদালতের নির্দেশে। এর সঙ্গে কেন্দ্রীয় সরকারের যোগাযোগ কোথায়!’’