উৎসব: গৌরপ্রাঙ্গণে বসন্তোৎসবের একটি মুহূর্ত। ফাইল চিত্র
সবার রঙে রং মেলানো ‘বসন্ত উৎসব’ আজ শান্তিনিকেতনে যে আকার নিয়েছে, তাকে ‘বসন্ত উৎসব’ না বলে ‘হুজুগ উৎসব’-ও বলা চলে। অনেকেই আছেন, যাঁরা শান্তিনিকেতনে ‘হোলি’ খেলতে আসতে চান। কিন্তু, শান্তিনিকেতনে যেটা হয়, সেটা প্রথাগত ‘হোলি’ নয়, একটি ঋতু উৎসব, যাকে আমরা ‘বসন্ত উৎসব’ বলি। ১৯০৭ সালে কবিপুত্র শমীন্দ্রনাথ (মাত্র ১১ বছরে যার অকালপ্রয়াণ ঘটে) বসন্ত পঞ্চমীর দিন আম্রকুঞ্জে এই উৎসবের সূচনা করেছিলেন। প্রতিটি ঋতুর সঙ্গে পরিচয় ঘটানোর জন্য রবীন্দ্রনাথ শান্তিনিকেতনে বিভিন্ন ঋতু উৎসবের আয়োজন করতেন। শমীন্দ্রনাথের উদ্যোগ সেখান থেকেই।
বিশ্বভারতী কিছুদিন আগে সিদ্ধান্ত নিয়েছিল, দোলের দিন বসন্তোৎসব না করে অন্য দিন করা হবে। খুব সাহসী এবং তাৎপর্যপূর্ণ এই সিদ্ধান্তে শান্তিনিকেতনের বাসিন্দাদের বড় অংশই আশ্বস্ত হয়েছিলেন। পূর্বে বেশ কয়েকবার প্রাক্তনীদের পক্ষ থেকে এই দিনটি বদলের জন্য কর্তৃপক্ষকে অনুরোধ জানানো হয়েছিল। কারণটা আর কিছুই নয়, কয়েক লক্ষ মানুষের ভিড়ে শান্তিনিকেতন দোলের দিন কার্যতন স্তব্ধ অচলায়তনে পরিণত হয়। ‘মোদের খোলা মাঠের খেলা’ সেদিন আর থাকে না, বদলে শুধুই ভিড়ের ঠ্যালা দেখতে হয়। গত বছরের অভিজ্ঞতাই বলে দিচ্ছে, বসন্ত উৎসবে কী হয় শান্তিনিকেতনে। ভিড়ে আটকে অ্যাম্বুল্যান্স দাঁড়িয়েছিল কয়েক ঘণ্টা, কোনও দিকে বেরনোর কোনও উপায় নেই, উপায় থাকেও না। যাঁরা প্রত্যক্ষদর্শী, তারাই জানেন। কিন্তু মানুষ এখানকার ঐতিহ্য না জেনে এবং না মেনে সকালে মঞ্চের অনুষ্ঠান শেষ হওয়ার আগেই আবির খেলতে শুরু করেন। শান্তিনিকেতনের রীতি মেনে আবির বাদ দিয়ে বাঁদরমুখি রঙের খেলা শুরু করেন অনেকে। শান্তিনিকেতনে এলে শান্তিনিকেতনের ঐতিহ্য মেনে উৎসবকে উপভোগ করা উচিত, তবেই সুস্থতা বজায় থাকে।
সেই বিশৃঙ্খলা এটাতেই অন্য দিনে বসন্ত উৎসব করার কথা ভাবা হয়েছিল। কিন্তু দিনবদলের সিদ্ধান্ত থেকে সরে আসতে হল। এমনটা ভাবার কারণ নেই যে, দিনবদলের সিদ্ধান্ত এই প্রথম নেওয়া হচ্ছিল। রবীন্দ্রনাথের জীবদ্দশাতেই বহুবার এমন হয়েছে, দোলের দিন বসন্ত উৎসবের আয়োজন না করে অন্য দিন হয়েছে। কবির সময়, সুস্থতা সব কিছু ভেবেই এই সিদ্ধান্ত নেওয়া হতো। তাই বর্তমান বছরে দিনবদল হলে ঐতিহ্যে আঘাত করার কথাটি আসত না। শুধু স্থান বদল করে বিশেষ লাভ কিছু হওয়ার নয় বলেই আমার মনে হয়।
আশির দশকের গোড়ায় আম্রকুঞ্জ থেকে গৌরপ্রাঙ্গণে নিয়ে যাওয়া হয় বসন্ত উৎসবকে। ভিড় বাড়তে থাকায় স্থান সঙ্কুলানের জন্য ২০০৭-’০৮ সালে সেটিরও স্থান পরিবর্তন হয়ে হয় আশ্রম মাঠ। কয়েক বছর আগে এক বার মেলার মাঠেও উৎসব হয়েছিল। এ বার আবারও সেখানে। স্থান পরিবর্তন যতই হোক, শান্তিনিকেতন-এর আয়তন কি তাতে বৃদ্ধি পায়? শান্তিনিকেতনের সীমিত আয়তন বসন্ত উৎসবের জনপ্লাবনকে ধরে রাখার পক্ষে যথেষ্ট নয়। পূর্ব-পশ্চিম, উত্তর-দক্ষিণ সব দিক থেকেই সারি সারি গাড়ি দাঁড়িয়ে থাকে। এক সেন্টিমিটার এগিয়ে বা পিছিয়ে যাওয়ার মতো পরিস্থিতি থাকে না। স্থানীয় বাসিন্দারা বাড়ির বাইরে পা রাখতে ভয় পান, বয়স্কদের কথা তো বাদই দিলাম। পরের দিন ছড়িয়ে থাকে শুধু প্লাস্টিক ব্যাগ! শুধু বোলপুর-শান্তিনিকেতনের ব্যবসার কথা নয়, অস্বাভাবিক ভিড়ে বিপদের কথাটাও মাথায় রাখা জরুরি। আরও একটা কথা। মঞ্চে অনুষ্ঠানের পর পাঠভবনের বাচ্চাদের ওই ভিড় ঠেলে ফিরিয়ে আনতে হয় হস্টেলে। দোলের দিনের অকল্পনীয় ভিড়ে যে কোনও মুহূর্তে দুর্ঘটনা ঘটতে পারে।
ফলে, দিন বদল না করে শুধুই স্থান বদল করে বিশৃঙ্খলা আদৌ ঠেকানো যাবে কি?
লেখক কলেজ শিক্ষক ও বিশ্বভারতীর প্রাক্তনী