তবু পাশে: (বাঁ দিকে) আমপানে ভেঙেছে ঘর। (ডান দিকে) সুন্দরবনের বাসন্তীতে ভাঙা ঘরের সামনে করিম। নিজস্ব চিত্র
ঘূর্ণিঝড়ের ঠিক দু’দিন পরে, বাসন্তী থেকে টানা ১৫ ঘণ্টা হেঁটে পৌঁছেছিলেন কলকাতায়। রেললাইন ধরে হেঁটেছিলেন তিনি। তার পরে পার্ক সার্কাসে ভিক্ষা করছিলেন ৫২ বছরের করিম আলি পিয়াদা। যদি কিছু খেতে পান, সেই আশায় রাস্তায় রাস্তায় দু’দিন ধরে ঘুরেছেন। পার্ক সার্কাস স্টেশনে থাকতেন, পাশের কবরস্থানে ত্রাণের দেওয়া খিচুড়ি-চাটনি খেতেন। এ শহরে এক সময়ে খেটে খাওয়া এক রিকশাচালক এ ভাবেই হয়ে উঠেছিলেন ভিক্ষাজীবী। সৌজন্যে, লকডাউন আর রাজ্যে ভয়াবহ ঘূর্ণিঝড়ের প্রকোপ।
গল্পটা এখানেই শেষ হয়ে যেতে পারত। কিন্তু মানুষটির সঙ্গে হঠাৎই পার্ক সার্কাসের রাস্তায় যোগাযোগ হয়ে যায় পরিযায়ী শ্রমিকদের নিয়ে কাজ করা একটি নাগরিক সংগঠনের উদ্যোক্তা জ্যোতিষ্ক দাসের। জ্যোতিষ্ক তাঁর খাবারের বন্দোবস্ত করেন। গাড়ি ভাড়া করে তাঁকে বাসন্তীর বাড়িতে পাঠিয়েও দেন। আমপানে ঘরবাড়ি ভেঙে যাওয়ার পরে যে গ্রাম থেকে কার্যত পালিয়ে এসেছিলেন কলকাতার ওই রিকশাচালক, সেখানেই ফিরে গিয়ে নতুন ভাবে মানুষের পাশে দাঁড়ান তিনি।
শুধুই নিজের অন্ন সংস্থানের চিন্তা করেননি ‘করিমদা’। গ্রামের অন্যদের জন্যও ত্রিপল, চাল-ডাল, তেল, নুন, সয়াবিন, চিঁড়ে, ছাতুর বন্দোবস্ত করেছেন। টাকার জোগান দিয়েছে ‘কোয়রান্টিনড স্টুডেন্ট ইয়ুথ নেটওয়ার্ক’ নামে শহরের ছাত্রছাত্রীদের একটি সংগঠন। ওই সব দুঃস্থ পরিবারের প্রয়োজনের তালিকা গ্রামে ফিরেই কলকাতায় পাঠিয়েছেন করিম। সেই গ্রাম, খিদের জ্বালা সহ্য করতে না-পেরে যেখান থেকে কার্যত পালিয়ে প্রাণ বাঁচান করিম।
আরও পড়ুন: বঙ্গে নতুন আক্রান্তের ৫৬ শতাংশ পরিযায়ী
করিম ফোনে জানালেন, তিনি শারীরিক প্রতিবন্ধী। এক সময়ে লরি চালাতেন। দুর্ঘটনায় একটি হাত বাদ যায়। তার পরে এক হাত নিয়েই কলকাতার পার্ক সার্কাসে রিকশা চালাতে শুরু করেন। লকডাউনের কিছু দিন আগে বাসন্তীতে নিজের বাড়িতে গিয়েছিলেন করিম। এর পরে সেখানেই আটকে পড়েন। পরিবারে অনেকগুলো পেট। অথচ, লকডাউনে রেশন থেকে পেতেন মাত্র পাঁচ কেজি চাল। অভাবের তাড়নায় স্ত্রী এবং ছেলেমেয়েদের বাসন্তীরই অন্য এলাকায় শ্বশুরবাড়িতে পাঠিয়ে দেন তিনি।
ঘরে বৃদ্ধ মা-বাবা, ভাই। একটা খিদের বোঝা কমাতে তাই শহরে চলে আসেন তিনি। কিন্তু এসে দেখেন, পার্ক সার্কাসের যে এলাকায় তিনি রিকশা চালাতেন, সেখানে রিকশা বন্ধ। অগত্যা, ভিক্ষা শুরু করেন।
আরও পড়ুন: লকডাউন সফল, বৈঠকে দাবি মোদীর
করোনার চেয়েও করিমকে তখন বেশি ভাবাচ্ছিল তাঁর উপরে নির্ভর করে থাকা পরিবারের মানুষগুলোর অসহায় দৃষ্টি। তিনি বলেন, ‘‘আমার চার ছেলেমেয়ে। এক জন পুকুরে ডুবে মারা গিয়েছে। কী করব, খেতে পাচ্ছিলাম না। তাই শহরে চলে গেলাম। লকডাউনের আগেই বাড়ি এসেছিলাম। যা টাকা জমিয়েছিলাম, এই আড়াই মাসে সব খরচ হয়ে গেল। আর ঝড়টার পরে সামলাতে পারলাম না। কিচ্ছু নেই, সব উড়ে গিয়েছে। ভাইয়ের ঘরে থাকছি এখন।’’
হয়তো খিদের জ্বালা বুঝতেন বলেই শুধু নিজেরটা বুঝে নেননি প্রতিবন্ধী মানুষটি। গ্রামের বাকি ১৯৭টি পরিবারের পাশে দাঁড়িয়েছেন। খেড়িয়া গ্রাম পঞ্চায়েতের ওই গ্রামে বৃহস্পতিবার পৌঁছে গিয়েছে আনাজ, ত্রিপল। সেই শহর থেকে, যেখানে খেতে পাওয়ার আশা নিয়ে পালিয়ে এসেছিলেন প্রতিবন্ধী করিম।