জ্যোতির্ময় চক্রবর্তী। নিজস্ব চিত্র।
এক সময়ে স্ত্রীর সঙ্গে ঘুরে-ঘুরে গ্রামে গাছ লাগানোর অভ্যাস ছিল বৃদ্ধের। ২০১৩ সালে কিডনির অসুখে সহধর্মিণী মারা গিয়েছেন। বৃদ্ধ হয়ে উঠেছেন ‘বনস্পতি’।
চাল, ডাল, নুন, লঙ্কা— যাঁর যা দরকার, তা ফর্দে লিখে পৌঁছে দেওয়া হয় তাঁর কাছে। নির্দিষ্ট সময় খবর দেয় মুদির দোকান। ফর্দ মিলিয়ে বাড়িতে জিনিস নিয়ে যান গ্রামবাসী ৩০টি পরিবার। এক পয়সাও খরচ করতে হয় না। বিল মেটান ‘গরিবের ভগবান’।
বর্ধমানের বোলপুর সীমানা ঘেঁষা, আউশগ্রামের ভেদিয়ার বাগবাটী গ্রামে বাস অবসরপ্রাপ্ত সরকারি আধিকারিক জ্যোতির্ময় চক্রবর্তীর। সাতাত্তর বছরের এই প্রবীণ নাগরিককে গ্রামের দুঃস্থ বাসিন্দারা ‘গরিবের ভগবান’ বলে ডাকতে পছন্দ করেন।
করোনা-পরিস্থিতিতে অনেক এলাকার মতো সঙ্কট নেমেছে জ্যোতির্ময়বাবুর গ্রামেও। নিত্য প্রয়োজনীয় দ্রব্য জোগাড়ে হিমশিম খাচ্ছেন দুঃস্থ গ্রামবাসী। এই পরিস্থিতিতে ২০২০ সালের মার্চের পর থেকে খেতমজুরি, দিনমজুরি করে চালানো ৩০টি গরিব পরিবারের পাশে দাঁড়িয়েছেন জ্যোতির্ময়বাবু।
ওই সব পরিবারের লোকেরা প্রতি মাসে তাঁদের প্রয়োজনীয় জিনিসপত্রের তালিকা করে দিয়ে আসেন জ্যোতির্ময়বাবুর বাড়িতে। সংশ্লিষ্ট ব্যক্তির নাম লিখে সে তালিকা জ্যোতির্ময়বাবু পাঠিয়ে দেন গ্রামের মুদির দোকানে। সেখান থেকে খবর পেলে, সেই বাসিন্দা নিয়ে আসেন জিনিসপত্র। শুধু মুদির দোকানের জিনিসই নয়, কারও শাড়ি বা লুঙ্গির প্রয়োজন হলে, তা-ও কিনে দেন রাজ্য আইবি-র অবসরপ্রাপ্ত ওই আধিকারিক। জানালেন, এ বাবদ মাসে খরচ গড়ে ১২ হাজার টাকা।
ইতিহাসে স্নাতকোত্তর এবং আইনের স্নাতক জ্যোতির্ময়বাবুর কর্মজীবন ৩৮ বছরের। মুখ্যমন্ত্রীর সচিবালয়ে দীর্ঘদিন কাজ করেছেন। আগে পুজোর সময়ে অনেককেই তিনি শাড়ি-কাপড় কিনে দিতেন। প্রয়াত স্ত্রী ছায়ারানি চক্রবর্তী এবং কলকাতা পুলিশের কর্মী দুই ছেলে— কাঞ্চন আর চন্দনের সমর্থনই সমাজসেবায় বৃদ্ধের শক্তি। জ্যোতির্ময়বাবু বলেন, ‘‘স্ত্রী ও আমার পেনশন বাবদ যে টাকা পাই, তারই একটা অংশ এ কাজে খরচ করি।’’
গ্রামের বাসিন্দা সন্তোষ মাহাতো বলেন, ‘‘এক বছরেরও বেশি সময় উনি এই কর্মকাণ্ডের সঙ্গে যুক্ত। ওঁকে আমরা গরিবের ভগবান বলি।’’ গ্রামের আর এক বাসিন্দা প্রশান্ত চক্রবর্তীর কথায়, ‘‘বিপদে ওঁর নামটাই প্রথম মাথায় আসে। যে কোনও কাজে উনি সবার আগে থাকেন।’’
জ্যোতির্ময়বাবুর থেকে নিয়মিত সাহায্য পাচ্ছেন গ্রামের আদুরি মাঝি, ইন্দ্রজিৎ গড়াই, ফুলকলি মাঝির মতো অনেকে। তাঁরা বলেন, ‘‘করোনার সময়ে কাজ ছিল না। উনি পাশে না দাঁড়ালে, না খেয়ে কাটাতে হত। ভগবানকে দেখিনি। ওঁকে দেখেছি।’’
জ্যোতির্ময় অবশ্য ‘ভগবান’ হতে চান না। বলেছেন, ‘‘যত দিন আছি, এ ভাবেই মানুষের পাশে থাকব। এটা বেশি কিছু নয়।’’