যাত্রা: বিমানবন্দরে (বাঁ দিকে) অজিতা এবং সুমন্ত। নিজস্ব চিত্র
বাবা মারা গিয়েছেন ছ’বছর আগে। তার পর থেকে সৎমা এবং সৎভাইকে নিয়েই সংসার সুমন্ত সরকারের।
বাবার মৃত্যুর আগেই পড়াশোনা বন্ধ করতে হয়েছিল সুমন্তকে। পেটের টানে পূর্ব দুর্গাপুরের বাড়ি ছেড়ে ছুটেছিলেন কেরল। কখনও প্লাইউডের কারখানায়, কখনও টালি তৈরির কাজে, কখনও দুধের প্যাকেট তৈরি করে যা রোজগার করেছেন, তার বেশির ভাগটাই পাঠিয়ে দিয়েছেন বাড়িতে।
সোমবার সকালে কলকাতা বিমানবন্দরের বাইরে বসে ওই যুবক বললেন, ‘‘ভাই ক্লাস সেভেনে পড়ে। ওর পড়াশোনা যাতে বন্ধ না-হয়, তার জন্য চেষ্টা চালিয়ে যাব।’’ সুমন্তের দাবি, কেরলে কাজের অভাব নেই। টালি তৈরির কাজ করতে করতে হাতে সমস্যা দেখা দিয়েছিল। তাই সেই কাজ ছেড়ে দুধের প্যাকেট তৈরির কাজ নেন। কিন্তু সেখানে মজুরি কম। সে কারণে দশ মাস আগে সব ছেড়ে বাড়ি ফিরে এসেছিলেন। কিন্তু এ রাজ্যে চেষ্টা করেও কাজ পাননি। এখন আবার টালির কাজ নিয়ে কেরলে ফিরে যাচ্ছেন সুমন্ত। আজ, মঙ্গলবার সকালের উড়ান। লকডাউনে আটকে পড়ার আশঙ্কায় সোমবার কাকভোরে চলে এসেছিলেন বিমানবন্দরে।
আলিপুরদুয়ারের বাসিন্দা অজিতা লোহারা চাদর পেতে বসেছিলেন টার্মিনালের বাইরে। রবিবার রাতে কোচি থেকে বেঙ্গালুরু হয়ে শহরে নেমেছিলেন। লকডাউনের হিসেব মাথায় ছিল না। ভেবেছিলেন, রাতটা বিমাবন্দরে কাটিয়ে সোমবার বাড়ি ফিরে যাবেন। কিন্তু আটকে পড়েন বিমানবন্দরেই। অজিতাও বলেন, ‘‘কেরলে গেলেই কাজ পাওয়া যাচ্ছে।’’ তিনি বছর দুয়েক সেখানে নিরাপত্তারক্ষীর কাজ করছিলেন। লকডাউন শুরু হতে সেই কাজ চলে যায়। একটি পেট্রল পাম্পে চাকরি জোগাড় করতে সময় লাগেনি। তিন মাস কাজ করে, সেই চাকরি ছেড়ে এখন বাড়ির প্রয়োজনে ফিরেছেন অজিতা।
আরও পড়ুন: আনন্দপুর-কাণ্ডে মিলল গাড়ির খোঁজ, আরও ঘনীভূত রহস্য
কিন্তু এখন ফিরে গেলে কাজ পাবেন? অজিতার কথায়, ‘‘না ফিরলে খাব কী? কেরলে আমার অনেক বন্ধু কাজ করেন। গেলেই চাকরি পাওয়া যাবে।’’ সুমন্ত ও অজিতা দু’জনেই জানান, লকডাউনের পরে এখন পুরোদমে কাজ শুরু হয়ে গিয়েছে কেরলে। সেখানকার স্থানীয় শ্রমিকদের বেশির ভাগই দুবাই, না হলে দোহা অথবা আমেরিকায় কাজ করেন। ফলে কেরলে দক্ষ শ্রমিকের খুব অভাব। বাঙালি শ্রমিকের কদরও বেশি।
উত্তর দিনাজপুরের রায়গঞ্জের বাসিন্দা পারভেজ আলম মুম্বই যাওয়ার টিকিট কেটেছিলেন। সোমবার যে লকডাউন, তা তাঁকে জানাননি এজেন্ট। রবিবার রাতে বাসে ধর্মতলায় নেমে সেখানে হোটেলে রাত কাটিয়ে সোমবার ভোরে বিমানবন্দরে পৌঁছে পারভেজ দেখেন, সব বন্ধ। এয়ার ইন্ডিয়া তাঁকে জানিয়েছে, আজ মঙ্গলবার সকালের উড়ানে জায়গা পেলে তিনি যেতে পারবেন। না হলে তাঁকে ১৩ তারিখ পর্যন্ত কলকাতায় থাকতে হবে।
পারভেজ মুম্বইয়ে টালির কাজ করছেন ১২ বছর ধরে। মাধ্যমিক পাশ করে গ্রামেরই এক জনের হাত ধরে মুম্বই পাড়ি দেন। ওই শ্রমিকের কথায়, ‘‘এ ভাবেই সংসারটা চলে। আমার হাত ধরেও কয়েক জন মুম্বই গিয়েছেন। ওখানে গেলে কাজ পাওয়া যায়।’’ মাসে রোজগার প্রায় ৩০-৩৫ হাজার টাকা। নিজের খরচ বলতে বড়জোর সাত হাজার টাকা। বাকি টাকার কিছুটা গ্রামে পাঠান। কিছুটা জমে।
এ রাজ্যে কাজ করেন না কেন? পারভেজের কথায়, ‘‘১৮-২০ হাজার টাকার কাজ পেলেও থেকে যেতাম। মাঝেমধ্যে বাড়িও যেতে পারতাম। স্ত্রী আর দুই মেয়ে আছে। কিন্তু এখানে কাজ কোথায়?’’