গ্রাফিক: আনন্দবাজার অনলাইন।
ফিরহাদ হাকিমকে সরিয়ে ‘ওয়েস্ট বেঙ্গল হাউজ়িং ইনফ্রাস্ট্রাকচার ডেভেলপমেন্ট কর্পোরেশন’ (হিডকো) –এর দায়িত্ব যে মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় নিতে পারেন, বৃহস্পতিবারেই সবচেয়ে আগে সেই খবর দিয়েছিল আনন্দবাজার অনলাইন। শুক্রবার সেই খবরে সিলমোহর দিলেন স্বয়ং ফিরহাদই। তিনি জানিয়ে দিয়েছেন, এ বিষয়ে কোনও গুঞ্জন নেই। এটা মন্ত্রিসভার সিদ্ধান্ত।
হিডকোর চেয়ারম্যান পদ থেকে ফিরহাদের অপসারণ নিয়ে প্রশাসন এবং শাসকদলের অন্দরে আলোচনা শুরু হয়েছে। সেই প্রসঙ্গে মন্ত্রী বলেন, ‘‘এটা মুখ্যমন্ত্রীর সিদ্ধান্ত। আমাকে দায়িত্ব দিয়েছিলেন। এখন উনি নিয়ে নিয়েছেন। এর মধ্যে কোনও গুঞ্জন নেই। এটা ক্যাবিনেটের (মন্ত্রিসভার) ডিসিশন। উনি কোনও কারণে নিশ্চয়ই নিয়েছেন।’’ সাম্প্রতিক নানা ঘটনার প্রেক্ষাপটে অনেকেই হিডকোর চেয়ারম্যান পদ থেকে তাঁর অপসারণকে ‘ক্ষমতা খর্ব’ হিসাবে ব্যাখ্যা করেছেন। সেই প্রসঙ্গে ফিরহাদ বলেছেন, ‘‘এর মানে এটা নয় যে, আমায় সাইড করা বা সরিয়ে দেওয়া হয়েছে। আমি দলের অনুগত সৈনিক। দল যে কাজ দেবে, নেত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় যেটা দেবেন, সেটাই আমি মাথা পেতে নেব। আমি দলের প্রথম দিনের সৈনিক।’’
রাজ্য মন্ত্রিসভার বৈঠকে ঠিক হয়েছে, হিডকোকে পুর ও নগরোন্নয়ন দফতরের অধীনে আর রাখা হবে না। আনা হবে প্রশাসনিক সংস্কার এবং কর্মিবর্গ দফতরের অধীনে। যে দফতর রয়েছে মুখ্যমন্ত্রী মমতার হাতেই। প্রশাসনিক রীতি মেনে মমতাই হিডকোর চেয়ারপার্সনের দায়িত্ব নেবেন বলে খবর। বাম আমলে হিডকো ছিল আবাসন দফতরের অধীনে। আবাসনমন্ত্রী হওয়ার সুবাদে সিপিএমের গৌতম দেব দীর্ঘদিন ছিলেন হিডকোর চেয়ারম্যান। মমতার শাসনের গোড়া থেকেই অবশ্য হিডকোকে পুর ও নগরোন্নয়ন দফতরের অধীনে আনা হয়েছিল। ১৪ বছর পরে ফের হিডকোর ‘অভিভাবক’ বদলাচ্ছে। যে প্রশাসনিক সিদ্ধান্ত রাজনৈতিক ভাবেও ‘তাৎপর্যপূর্ণ’ বলে মনে করা হচ্ছে।
সম্প্রতি আলিপুরের ধনধান্য প্রেক্ষাগৃহে একটি অনুষ্ঠানে সংখ্যালঘুদের জড়িয়ে ফিরহাদের একটি মন্তব্য নিয়ে বির্তক হয়েছিল। বাংলাদেশে সংখ্যালঘুদের উপর আক্রমণের আবহে যে মন্তব্য ‘বিড়ম্বিত’ করেছিল শাসকদলের সর্বোচ্চ নেতৃত্বকেও। সেই প্রেক্ষাপটে হিডকোর দফতর বদল ঘটানোর সিদ্ধান্ত শুধুই প্রশাসনিক সংস্কার না কি এর সঙ্গে জুড়ে রয়েছে ফিরহাদের ক্ষমতা ‘খর্ব’ করার বিষয়, তা নিয়ে আলোচনা শুরু হয়েছে। অনেকে এই সিদ্ধান্তকে ২০২৬ সালের বিধানসভা ভোটের আগে ফিরহাদের উদ্দেশে মমতার ‘সতর্কবার্তা’ বলেও অভিহিত করতে চাইছেন। যদিও ফিরহাদ তা মানতে চাননি।
নবান্নের এক আধিকারিকের বক্তব্য, ‘‘সম্প্রতি হাতিশালায় ইনফোসিসের নতুন ক্যাম্পাস উদ্বোধনের অনুষ্ঠান আয়োজন করেছিল হিডকো। কিন্তু হিডকোর চেয়ারম্যান ফিরহাদ নিজেই ওই অনুষ্ঠানে যাননি। বরং অনুষ্ঠানে মুখ্যমন্ত্রীই ছিলেন প্রধান অতিথি। সে দিনই হিডকো নিয়ে রাজ্য সরকারের পরিকল্পনা প্রশাসনিক কর্তাদের কাছে স্পষ্ট হয়েছিল।’’ তবে নবান্নের অন্য একটি সূত্রের বক্তব্য, ২০২৬ সালের বিধানসভা নির্বাচনের আগে ২০২৫ সালই ‘পূর্ণাঙ্গ বছর’ হিসাবে হাতে পাবেন মমতা। বছরের গোড়ায় ৫-৬ ফেব্রুয়ারি নিউটাউনে অনুষ্ঠিত হবে বিশ্ববঙ্গ বাণিজ্য সম্মেলন (বিজিবিএস)। সেই সময় রাজ্যে বিনিয়োগ আনার ক্ষেত্রে হিডকোকে ব্যবহার করতে চান মুখ্যমন্ত্রী। তাই এ বছর নয়া কৌশলে বিজিবিএস সাজানোর পরিকল্পনা নিয়েছেন তিনি। সেই পরিকল্পনার নীল নকশা হিসেবেই তাঁর এই পদক্ষেপ।
তবে প্রশাসন এবং রাজনৈতিক মহলের অনেকে আরও একটি প্রেক্ষাপটের কথা বলছেন। তাঁদের বক্তব্য, হিডকোতে এই রদবদলের নেপথ্যে রয়েছে ‘মন্দির রাজনীতি’। এক সময়ে পুরমন্ত্রী হিসাবে তারকেশ্বর মন্দির এলাকা উন্নয়ন পর্ষদের চেয়ারম্যান হয়েছিলেন ফিরহাদ। তা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছিল বিজেপি। সে কথা এখনও মাথায় রয়েছে মুখ্যমন্ত্রীর। দিঘায় জগন্নাথ মন্দির তৈরি হচ্ছে হিডকোর পৌরোহিত্যে। সপ্তাহ দেড়েক আগে সেই কাজ পরিদর্শনে গিয়েছিলেন মমতা। আগামী অক্ষয় তৃতীয়ায় দিঘার ওই মন্দিরের উদ্বোধন হবে। মন্দির তৈরি হয়ে গেলে তা পরিচালনার জন্য ট্রাস্টি বোর্ড গঠন করা হবে। সেই সময় হিডকোর চেয়ারম্যান পদে থাকলে সরকারি নিয়মেই ফিরহাদকে ওই ট্রাস্টি বোর্ডে জায়গা দিতে হত। তাতে বিজেপি যে তাদের ‘রাজনীতি’ করার সুযোগ পেয়ে যাবে, তা বিলক্ষণ জানেন পোড়খাওয়া রাজনীতিক মমতা। বিধানসভা নির্বাচনের আগে পদ্মশিবির যাতে মেরুকরণের ‘নতুন হাতিয়ার’ না পায়, এই সিদ্ধান্তের মাধ্যমে সেটাই নিশ্চিত করতে চেয়েছেন মুখ্যমন্ত্রী।