পাহাড়প্রমাণ: মহেশতলা থানায় বাজেয়াপ্ত হওয়া বেআইনি বাজি। ছবি: অরুণ লোধ।
বিস্ফোরণের শব্দ থামতে চাইছে না রাজ্যে। এক সপ্তাহ আগে গত মঙ্গলবার প্রথম বেআইনি বাজি কারখানায় বিস্ফোরণ হয় পূর্ব মেদিনীপুরের এগরায়। সেই ঘটনায় অন্তত ৯ জনের মৃত্যু হয়েছিল। তার পর থেকে একে একে বজবজ, দুবরাজপুর এবং শেষে মঙ্গলবার সকালে মালদহেও বিস্ফোরণের শব্দে কেঁপে উঠেছে ইংরেজ বাজার। এর মধ্যে দুবরাজপুরের ঘটনাটি ছাড়া বাকি ৩টিই বেআইনি বাজি থেকে হওয়া বিস্ফোরণ। আর ৩টি ঘটনাতেই এক বা একাধিক মৃত্যু হয়েছে। গুরুতর জখমও হয়েছেন অনেকে। বীরভূমের দুবরাজপুরে অবশ্য কারও মৃত্যু হয়নি। ওই বিস্ফোরণটিও বেআইনি বাজির কারণে হয়নি বলে খবর। এরই মধ্যে মঙ্গলবার রাজ্য পুলিশ সূত্রে জানা গেল গত ৬দিনে গোটা রাজ্যের বিভিন্ন জেলা থেকে ১,১৪, ২৩২ লক্ষ কেজি বাজি এবং ২৭,৬৩২ কেজি বারুদ-সহ বাজি তৈরির সামগ্রী বাজেয়াপ্ত করা হয়েছে। এগরা বিস্ফোরণের পর রাজ্যের জেলায় জেলায় যে বেআইনি বাজি উদ্ধারের অভিযান শুরু করেছিল পুলিশ, সেই অভিযানেই গত ৬দিনে হাতে এসেছে এই ফল। আর এই সব কিছু নিয়েই রাজ্য সরকারের উপর খড়্গহস্ত হয়েছে বিরোধীরা।
রাজ্য সরকারের তরফে ইতিমধ্যেই বেআইনি বাজি উদ্ধার করা নিয়ে বেশ কিছু পদক্ষেপ করা হয়েছে। বিস্ফোরণস্থলে গিয়েছে ফরেন্সিক দল। তদন্তের দায়িত্ব নিয়েছে রাজ্যের গোয়েন্দা সংস্থা সিআইডি। অন্য দিকে, মঙ্গলবার নবান্নে বাজি সংক্রান্ত বিষয়ে ২টি বৈঠকও ডাকা হয়। এর মধ্যে একটি ডেকেছিলেন রাজ্যের মুখ্যসচিব হরিকৃষ্ণ দ্বিবেদী। সেই বৈঠক ছিল বিভিন্ন জেলার প্রশাসনিক আধিকারিক ছাড়াও কয়েক’টি বাজি ব্যবসায়ী সমিতির প্রতিনিধিদের নিয়ে। নবান্নে বাজি সংক্রান্ত দ্বিতীয় বৈঠকটি হয় রাজ্য পুলিশের ডিজি মনোজ মালবিয় এবং এডিজি (আইনশৃঙ্খলা) মনোজ বর্মার নেতৃত্বে। ভার্চুয়াল মাধ্যমে ওই বৈঠকে যোগ দেন রাজ্যের পুলিশ কমিশনার থেকে শুরু করে জেলার পুলিশ সুপারেরা। তবে সরকার পদক্ষেপ করলেও বিরোধীরা গাফিলতির অভিযোগে ক্রমশ আক্রমণ তীব্র করতে শুরু করেছে। ইতিমধ্যেই এগরায় এনআইএ তদন্তের দাবি জানিয়েছিলেন রাজ্যের বিধানসভার বিরোধী দলনেতা শুভেন্দু অধিকারী। মঙ্গলবার নন্দীগ্রামের বিজেপি সাংসদ এগরায় বিস্ফোরণের পর পুলিশি সন্ত্রাসের অভিযোগও করেছেন। রাজ্য সরকারের উদ্দেশে এক রকম হুঁশিয়ারি দিয়েই শুভেন্দুর হুঁশিয়ারি, পুলিশ নিজেকে সংযত না করলে এগরায় থানা ঘেরাও করা হবে।
মঙ্গলবার সকাল থেকে মালদহে বাজি বিস্ফোরণ ঘিরে কী ভাবে এগোল ঘটনাপ্রবাহ? এক নজরে দেখে নেওয়া যাক—
ইংরেজবাজারে বিস্ফোরণ
মালদহে বাজির গুদামে বিস্ফোরণ হয় মঙ্গলবার সকাল ৬টা ৪৫ মিনিটে। মালদহের ইংরেজবাজার পুরসভার নেতাজি পুরবাজার এলাকায় বিস্ফোরণের শব্দ শুনে স্থানীয়েরা প্রথমে ভেবেছিলেন কোথাও বোমা ফেটেছে। কিন্তু পরে জানা যায়, বাজারে যে বাজির গুদাম রয়েছে, সেখানে হয়েছে বিস্ফোরণ। স্থানীয় সূত্রে খবর, ওই বাজির গুদাম ঘিরে একাধিক বাজির দোকানও ছিল। সকালে গুদামের সামনে গাড়ি থেকে কার্বাইড নামানো হচ্ছিল। সেই কার্বাইড অসাবধানতায় নীচে পড়ে যায়। তার পরেই শুরু হয় পর পর বিস্ফোরণ। আগুন ধরে যায় গুদামে এবং সংলগ্ন এলাকায়। ওই ঘটনায় অগ্নিদগ্ধ হয়ে দুই বাজি শ্রমিকের মৃত্যু হয়। আশঙ্কাজনক অবস্থায় হাসপাতালে ভর্তি আছেন আরও অন্তত ২জন।
সৌগতর বাজি-ব্যাখ্যা ও বিতর্ক
রাজ্যে একাধিক জায়গায় বাজি কারখানায় বিস্ফোরণের ঘটনার একটি ব্যাখ্যা দেন তৃণমূল সাংসদ সৌগত রায়। যা নিয়ে শুরু হয় বিতর্ক। এককালের পদার্থবিদ্যার অধ্যাপক সৌগত বলেন, ‘‘তীব্র গরমে বিস্ফোরণ হতেই পারে। এই গরমে পটাশিয়াম ক্লোরেট, আর্সেনিক ট্রাই সালফেড বাইরে রেখে দিলে এমনিই ফেটে যাবে।’’ একই সঙ্গে সৌগত রাজ্যের বাজি অভিযান নিয়ে তাঁর মত প্রকাশ করে বলেন, ‘‘বাজি এবং বিস্ফোরক উদ্ধারে পুলিশ-প্রশাসন সম্পূর্ণ সফল না-ও হতে পারে। রাজ্যে ৩৮ হাজার গ্রাম। পুলিশ কী ভাবে খুঁজবে, কোথায় কোথায় বোমা লুকিয়ে আছে!’’ সৌগতের এই মন্তব্যের সমালোচনা করেন বিরোধীরা। বিজেপি নেতা সজল ঘোষ বলেন, ‘‘গরমে শুধু বাজিই ফাটে না, অনেকের মানসিক বিকৃতিও হয়।’’ বিজেপি এ-ও অভিযোগ করে যে, রাজ্যে বেআইনি বাজি কারখানায় বিস্ফোরণ এবং মৃত্যুর ঘটনায় প্রশাসনিক যে ব্যর্থতা প্রকাশ্যে আসছে, তা ঢাকতেই এমন আলটপকা মন্তব্য করছে শাসকদল।
নবান্নে জো়ড়া বৈঠক
রাজ্যে পর পর বাজি বিস্ফোরণের আবহে মঙ্গলবার ২টি বাজি সংক্রান্ত বৈঠক ডাকা হয় নবান্নে। একটি বাজি ব্যবসায়ী এবং বিভিন্ন জেলার প্রশাসনিক কর্তাদের নিয়ে। ওই বৈঠক ডাকেন রাজ্যের মুখ্যসচিব হরিকৃষ্ণ দ্বিবেদী। অন্য বৈঠকটি ডাকেন রাজ্য পুলিশের ডিজি মনোজ মালবিয়। নবান্ন সূত্রে খবর, দ্বিতীয় বৈঠকে বিভিন্ন জেলার পুলিশ সুপার এবং গোয়েন্দা বিভাগের ভূমিকা নিয়ে প্রশ্ন তোলেন ডিজি। পুলিশ এবং গোয়েন্দাদের কাছে বেআইনি বাজি সংক্রান্ত তথ্য না থাকায় ক্ষোভও প্রকাশ করেন তিনি। মঙ্গলবার ওই বৈঠকে পুলিশ সুপারদের বিশেষ নির্দেশ দিয়ে বলা হয়, তাঁরা যেন জেলার গোয়েন্দা বিভাগকে সক্রিয় করেন। একই সঙ্গে বেআইনি আতশবাজি কতটা উদ্ধার করা সম্ভব হয়েছে, বেআইনি বাজি ব্যবসার সঙ্গে যুক্ত কত জনকে গ্রেফতার করা হয়েছে এবং তাঁদের বিরুদ্ধে কী কী ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে তাও জানাতে বলা হয় জেলার পুলিশ সুপারদের।
দেড়লক্ষ কেজি বাজি-বারুদ
বাজি বিস্ফোরণ এবং পর পর মৃত্যুর ঘটনার আবহেই মঙ্গলবার প্রকাশ্যে এসেছে একটি পরিসংখ্যান। পুলিশ সূত্রে জানা গিয়েছে, ১৭ মে থেকে এ পর্যন্ত গত ৬দিনে ১ লক্ষ ১৪ হাজার ২৩২ কেজি ওজনের বেআইনি বাজি উদ্ধার করা হয়েছে। তবে এটি শুধুই বাজির পরিমাণ। এ ছাড়াও বাজি বানাতে ব্যবহৃত অতি দাহ্য বারুদও উদ্ধার করা হয়েছে। গত ৬ দিনে ২৭ হাজার ৬৩৫ কেজি বাজি বানানোর কাঁচামালও বাজেয়াপ্ত করা হয়েছে বিভিন্ন জেলা থেকে। মঙ্গলবার পর্যন্ত গত ৬দিনে বেআইনি বাজি সংক্রান্ত ১৫২ টি মামলা হয়েছে। গ্রেফতার করা হয়েছে ১৪৩ জনকে।
শুভেন্দুর এগরা অভিযান
এগরায় পুলিশি সন্ত্রাসের অভিযোগ তুলে পুলিশকে ‘ধমক’ দিলেন রাজ্যের বিরোধী দলনেতা শুভেন্দু। বিজেপি বিধায়কের অভিযোগ, গত মঙ্গলবার এগরার খাদিকুল গ্রামে বিস্ফোরণের পর পুলিশ ঘটনাস্থলে এলে গ্রামবাসীরা তাঁদের উপর চড়াও হন। তার পরেই গ্রামে পুলিশি ধরপাকড় শুরু হয়। পুলিশি অভিযানের জেরে গ্রামের পুরুষেরা ঘর ছাড়তে বাধ্য হন। পুলিশকে এর পর হুঁশিয়ারি দিয়ে শুভেন্দু বলেন, ‘‘আমি আর ২-৩ দিন দেখব। তার পরেও পুলিশ সংযত না হলে আমরা এগরা থানা ঘেরাও অভিযানে নামব।’’