(বাঁ দিকে) শুক্রবার পর্যন্ত আমরা বিচারক দাসের ছবি প্রকাশ করিনি তাঁর নিরাপত্তার কারণে। শনিবার অনুমতিক্রমেই আমরা বিচারক দাসের ছবি প্রকাশ করলাম। (ডান দিকে) ধর্ষণ বা শ্লীলতাহানির ঘটনায় যত ক্ষণ না অভিযুক্তকে ‘দোষী’ সাব্যস্ত করা হচ্ছে, তত ক্ষণ তাঁর নাম, পরিচয় প্রকাশে আইনি বাধা থাকে। আনন্দবাজার অনলাইন সেই নিয়ম মেনেই আরজি কর পর্বের প্রথম দিন থেকে অভিযুক্তের নাম বা ছবি প্রকাশ করেনি। শনিবার আদালত তাঁকে দোষী সাব্যস্ত করায় আমরা তাঁর নাম এবং ছবি প্রকাশ করা শুরু করছি। —নিজস্ব চিত্র।
বিচারক দাস সিভিক ভলান্টিয়ার সঞ্জয় রায়ের উদ্দেশে বলেন, ‘‘সিবিআই এবং সাক্ষীদের বয়ানের ভিত্তিতে যা মনে হয়েছে তাতে দোষী সাব্যস্ত করব আপনাকে। আপনার সর্বোচ্চ শাস্তি হতে পারে মৃত্যুদণ্ড।’’ সেটা শুনে সঞ্জয় বলেন, ‘‘আমি কিছু করিনি। আমার গলায় রুদ্রাক্ষের মালা। আমার কথাটা এক বার শুনুন।’’ বিচারক রায় ঘোষণা করে বলে দেন, ‘‘সোমবার আপনার কথা শুনব।’’
রায় শুনে চোখে জল নির্যাতিতার বাবার। তিনি বিচারকের উদ্দেশে বলেন, ‘‘আপনার উপর যে আস্থা ছিল, তার পূর্ণ মর্যাদা দিয়েছেন।’’ বিচারক দাস প্রত্যুত্তরে বলেন, ‘‘সোমবার আসুন।’’
আরজি কর মেডিক্যাল কলেজের চিকিৎসকের ধর্ষণ এবং খুনের ঘটনায় দোষী সাব্যস্ত হলেন সিভিক ভলান্টিয়ার সঞ্জয় রায়। শনিবার শিয়ালদহ আদালতের বিচারক অনির্বাণ দাস ওই রায় ঘোষণা করেন। তিনি জানান, দোষীর সর্বোচ্চ সাজা হবে মৃত্যুদণ্ড। সর্বনিম্ন সাজা যাবজ্জীবন কারাদণ্ড। বস্তুত, আরজি কর-কাণ্ডে একমাত্র অভিযুক্ত হিসাবে সঞ্জয়ের নাম করেছিল সিবিআই। ভারতীয় ন্যায় সংহিতার ৬৪ (ধর্ষণ), ৬৬ (ধর্ষণের পর মৃত্যু) এবং ১০৩ (১) (খুন) ধারায় দোষী সাব্যস্ত করা হয়েছে সঞ্জয়কে।
আরজি কর মামলায় দোষী সাব্যস্ত সিভিক ভলান্টিয়ার সঞ্জয় রায়। আগামী সোমবার দুপুর সাড়ে ১২টায় রায় ঘোষণা করবে আদালত, জানালেন বিচারক অনির্বাণ দাস।
দোষী সাব্যস্ত হলেন আরজি কর মামলার ধৃত সিভিক ভলান্টিয়ার সঞ্জয় রায়। রায় ঘোষণা হবে আগামী সোমবার।
আরজি করের চিকিৎসকের ধর্ষণ এবং খুন মামলায় বিচারপ্রক্রিয়া শুরু হয় গত বছরের ১১ নভেম্বর। বিচারপর্ব শুরু হয় ঘটনার ৫৯ দিনের মাথায়। ঘটনার ১৬২ দিনের মাথায় রায় ঘোষণা করল আদালত।
আরজি কর-কাণ্ডে একমাত্র অভিযুক্ত হিসাবে সঞ্জয়ের নাম করেছিল সিবিআই। ভারতীয় ন্যায় সংহিতার ৬৪ (ধর্ষণ), ৬৬ (ধর্ষণের পর মৃত্যু) এবং ১০৩ (১) (খুন) ধারায় দোষী সাব্যস্ত করা হয়েছে ওই সিভিক ভলান্টিয়ারকে।
গত ৯ অগস্ট আরজি কর হাসপাতালের চেস্ট মেডিসিন বিভাগের সেমিনার হল থেকে ওই মহিলা চিকিৎসকের দেহ উদ্ধার হয়। তাঁকে ধর্ষণ এবং খুন করা হয়েছে বলে অভিযোগ ওঠে। ঘটনার দিন রাতেও হাসপাতালে ‘ডিউটি’ ছিল তাঁর।
সিসিটিভি ফুটেজে দেখা যায় সিভিক ভলান্টিয়ার সঞ্জয়কে ওই সেমিনার হল-এ ঢুকতে এবং সেখান থেকে বেরোতে। ঘটনার পর দিন অর্থাৎ, ১০ অগস্ট টালা থানার পুলিশের হাতে গ্রেফতার হন সঞ্জয়।
আরজি করের ধর্ষণ এবং খুনের মামলায় বিচারপ্রক্রিয়া শুরু হয় গত ১১ নভেম্বর। ঘটনার ৫৯ দিনের মাথায় বিচারপর্ব শুরু হয়েছিল। গত ৯ জানুয়ারি রায় ঘোষণার দিন জানিয়েছিল শিয়ালদহ আদালত। সে দিন সিবিআইয়ের আইনজীবী, নির্যাতিতার পরিবারের সদস্যেরা এবং তাঁদের আইনজীবীরাও উপস্থিত ছিলেন। সেখানে ধৃত সিভিক ভলান্টিয়ারকে একমাত্র ‘অভিযুক্ত’ হিসাবে উল্লেখ করে সিবিআই। আদালতে তাঁর ‘সর্বোচ্চ শাস্তি’র আবেদন করেন ওই কেন্দ্রীয় তদন্তকারী সংস্থার আইনজীবী।
আরজি করের ঘটনায় সঞ্জয়ের বিরুদ্ধেই চার্জশিট দিয়েছিল সিবিআই। ওই ঘটনাকে ‘বিরলের মধ্যে বিরলতম’ বলে উল্লেখ করেন সিবিআইয়ের আইনজীবী। অন্য দিকে, গত ৯ জানুয়ারি শেষ শুনানিতে নির্যাতিতার পরিবারের আইনজীবী আদালতে সওয়াল করতে গিয়ে তদন্তপ্রক্রিয়া নিয়ে অসন্তোষ প্রকাশ করেন। তদন্ত ঠিক ভাবে হয়নি বলেও অভিযোগ করেন তিনি।
আরজি কর-কাণ্ডের দোষীর ফাঁসির পক্ষেই সওয়াল করেছে রাজ্য। সিবিআইও সঞ্জয়ের মৃত্যুদণ্ডের পক্ষে সওয়াল করে আদালতে।
এর আগে কলকাতা হাই কোর্টের দ্বারস্থ হয়েছিলেন নির্যাতিতার বাবা-মা। সেখানে সরাসরি কেন্দ্রীয় তদন্তকারী সংস্থা সিবিআইয়ের বিরুদ্ধে প্রমাণ লোপাটের অভিযোগ তোলেন তাঁরা। নতুন করে তদন্তের আর্জিও জানান। শুনানির শেষ দিনে নির্যাতিতার বাবার সন্দেহ ছিল, ওই ঘটনায় চার জুনিয়র ডাক্তারের হাত থাকতে পারে। তিনি বলেছিলেন, ‘‘ওই দিন (৮ অগস্ট) রাতে যাঁরা আমার মেয়ের সঙ্গে ছিলেন, তাঁদের আমরা প্রচণ্ড ভাবে সাসপেক্ট (সন্দেহ) করছি। ডিএনএ রিপোর্ট তো পাওয়া গিয়েছে। তথ্যপ্রমাণ দেখেছেন। কোনও মহিলার উপস্থিতি ছিল সেখানে।’’ এমনকি, সিবিআইকে তিনি ‘বিরোধী’ বলেও মন্তব্য করেন। রায় ঘোষণার আগে নির্যাতিতার বাবা নিশানা করেন মমতাকে। তিনি বলেন, ‘‘মুখ্যমন্ত্রী নিজে বলেছিলেন, রাত ২টো পর্যন্ত জেগে মনিটর করেছিলেন। ওঁর কী ইন্টারেস্ট ছিল জানতে চাই। তথ্যপ্রমাণ যে লোপাট হয়েছে, সেটা সিবিআই বলেছে। শুধু সিভিক নয়, সব দোষী সামনে আসবে।’’
আরজি কর মামলার সঙ্গে বার বার ধনঞ্জয় চট্টোপাধ্যায়ের ফাঁসির প্রসঙ্গ উঠে এসেছে। কলকাতায় হেতাল পারেখ ধর্ষণ এবং খুনের মামলায় ২০০৪ সালের ১৪ অগস্ট ফাঁসি হয় বাঁকুড়ার বাসিন্দা ধনঞ্জয়ের। তার পর পশ্চিমবঙ্গে কোনও মামলায় মৃত্যুদণ্ড কার্যকর হয়নি। শিয়ালদহ আদালতের নির্দেশ কার্যকর হলে ২১ বছর পরে এ রাজ্যে ধর্ষণ এবং খুনের মামলায় আবার মৃত্যুদণ্ড হবে।
গত বছরের অগস্টে আরজি কর-কাণ্ডের পর বিভিন্ন প্রেক্ষিতে আলোচনায় উঠে এসেছে ধনঞ্জয়-কাণ্ড। মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ও বলেছিলেন, ‘‘ধনঞ্জয়ের ঘটনা মনে আছে তো? দোষী সাজা পাক, কিন্তু দেখতে হবে নির্দোষ যেন সাজা না পান।’’
ধর্ষণ এবং খুনের ঘটনায় ফাঁসির সাজাপ্রাপ্ত ধনঞ্জয় ‘প্রকৃত দোষী’ ছিলেন, না কি তাঁকে ফাঁসানো হয়েছিল, তা নিয়ে অতীতেও বিতর্ক হয়েছে। সম্প্রতি ফাঁসির মামলা পুনর্বিচারের দাবি ঘিরে তৎপরতা শুরু হয়েছে রাজ্যের আইন দফতরে। ফাঁসির দু’দশক পরে ওই মামলা কী ভাবে ‘রিওপেন’ করা যায়, তার আইনগত দিক খতিয়ে দেখছে সরকারি মহল। দেশের অন্য কোনও রাজ্যে এমন মামলা এর আগে হয়েছে কি না এবং কোন আইনি যুক্তিতে ফাঁসি বা মৃত্যুদণ্ডের পরেও মামলাটির নতুন করে শুনানি হয়েছিল, তার বিস্তারিত তথ্য সংগ্রহ করার প্রক্রিয়া চলছে।
বহু আন্দোলনকারী চিকিৎসক এবং পড়ুয়ার এটাই বদ্ধমূল ধারণা যে, আরজি করে চিকিৎসকের খুন এবং ধর্ষণের ঘটনায় কোনও ভাবেই এক জন জড়িত নন। নির্যাতিতার পরিবারের দাবিও তেমনই। অনেকে দাবি করেছেন, ‘বড় কাউকে’ আড়াল করতে সিভিক ভলান্টিয়ার সঞ্জয়কে ‘বলির পাঁঠা’ করা হচ্ছে। যে প্রশ্নের জবাব খুঁজতে ধনঞ্জয়-মামলা ‘রিওপেন’ করার উদ্যোগ নিয়েছে রাজ্য। বস্তুত, যখন কোনও মামলায় প্রত্যক্ষ সাক্ষ্য থাকে না, তখন পারিপার্শ্বিক সাক্ষ্যের উপর নির্ভর করে আদালত। ধনঞ্জয়ের মামলাও ছিল সে রকমই।
আরজি করের ঘটনার পরেও রাজ্যে বেশ কয়েকটি ধর্ষণ এবং খুনের অভিযোগ উঠেছিল। শিলিগুড়ির কাছে মাটিগাড়া, দক্ষিণ ২৪ পরগনার জয়নগর এবং মুর্শিদাবাদের ফরাক্কায় নাবালিকাকে ধর্ষণ-খুনের ঘটনাতেও মূল অভিযুক্তকে ফাঁসির সাজা দিয়েছে নিম্ন আদালত। এদের মধ্যে ফরাক্কা ধর্ষণ-খুনের মামলায় অভিযুক্ত কলকাতা হাই কোর্টের দ্বারস্থ হয়েছেন। আবেদন গৃহীত হলেও এখনও শুনানি হয়নি। বাকি দু’টি মামলার আসামিরাও হাই কোর্টের দ্বারস্থ হয়েছেন।