ছবি: পিটিআই।
কবিরা ভবিষ্যৎ-দ্রষ্টা হন। অন্তত সুকুমার রায় ত্রিকালদর্শী ছিলেন। নেটরাজ্যে জনপ্রিয় হযবরল-র একটি উদ্ধৃতিতে সেটাই মালুম হচ্ছে।
‘একজনের মাথার ব্যারাম ছিল, সে সব জিনিসের নামকরণ করত। তার জুতোর নাম ছিল অবিমৃষ্যকারিতা, তার ছাতার নাম ছিল প্রত্যুৎপন্নমতিত্ব, তার গাড়ুর নাম ছিল পরমকল্যাণবরেষু— কিন্তু যেই তার বাড়ির নাম দিয়েছে কিংকর্তব্যবিমূঢ়, অমনি ভূমিকম্প হয়ে বাড়িটাড়ি সব পড়ে গিয়েছে।’
রবিবারের সাতসকালে বেমালুম একটা নাম পাল্টে গেল কলকাতায়। এ দেশের ইতিহাসে গুরুত্বপূর্ণ, ব্রিটিশ উপনিবেশের অন্যতম প্রধান বন্দর কলকাতা পোর্টের নামটাই বেবাক পরিবর্তিত। এ বার থেকে তার নাম ‘ডক্টর শ্যামাপ্রসাদ মুখার্জি বন্দর’ বলে খ্যাত হবে, ঘোষণা করলেন খোদ প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী।
আরও পড়ুন: শ্যামাপ্রসাদের নামে কলকাতা বন্দর, শুরু বিতর্কও
২০২০ সালের ভারতে মোদী-জমানার পটভূমিতে মোদী অবশ্য ঠিক ‘এক জন’ নন। এই নামের নেশা একটা মতাদর্শের ধারক ও বাহক। মোদী-জমানার গুরুত্বপূর্ণ চরিত্র, উত্তরপ্রদেশের মুখ্যমন্ত্রী আদিত্যনাথ যোগী তো ইতিমধ্যেই তাঁর নামকরণের ক্ষমতায় প্রায় আস্ত একখানা লোকগাথা তৈরি করে ফেলেছেন সোশ্যাল মিডিয়ায়! ইলাহাবাদের নাম ‘প্রয়াগরাজ’, ফৈজ়লাবাদের নাম ‘অযোধ্যা’ এবং মোগলসরাই রেল স্টেশনের নাম ‘দীনদয়াল উপাধ্যায়’ দেওয়া হয়েছে ইতিমধ্যেই। শোনা যাচ্ছে, সম্ভাব্য নাম বদলের তালিকায় রয়েছে তাজমহল-নগরী আগরা (আগরবন) এবং মজফ্ফরনগর (লক্ষ্মীনগর)-ও।
শুধু উত্তরপ্রদেশ নয়, নাম বদলের বাতিক দেখা যাচ্ছে অন্যত্রও। আমদাবাদের নাম কর্ণাবতী, আওরঙ্গাবাদের নাম শম্ভাজিনগর, ভোপালের নাম ভোজপাল বা হায়দরাবাদের নাম ভাগ্যনগর পর্যন্ত রয়েছে প্রস্তাবনায়। অনেকেরই পর্যবেক্ষণ, যে-কোনও নামের মধ্যে ইসলাম-সংস্রবের নামগন্ধটুকু মুছে দেওয়াই মোদী-জমানার নামকরণ-প্রবণতার প্রকৃত উদ্দেশ্য। ‘করাচি বেকারি’ নামের জন্য ভাঙচুরের ঘটনাও দেখেছে সাম্প্রতিক ভারত। তা ছাড়া দেশের ইতিহাসবিদদের ভাষ্য ঘিরেও বরাবরই ক্ষোভ রয়েছে বিজেপি এবং সঙ্ঘ পরিবারের। এ বারের কলকাতা-সফরে সেই বিষয়ে মুখও খুলেছেন মোদী। তার পরেই তাঁর মুখ দিয়ে শ্যামাপ্রসাদ মুখোপাধ্যায়ের নামে কলকাতা বন্দরকে চিহ্নিত করার সিদ্ধান্ত ঘোষণা অনেকের কাছেই তাৎপর্যপূর্ণ ঠেকছে।
ইতিহাসবিদ রজতকান্ত রায়ের কথায়, ‘‘কিছু ক্ষেত্রে ইতিহাসের অনুষঙ্গ থাকে। কেনেডি-হত্যার পরেই নিউ ইয়র্কে জেএফকে বিমানবন্দরের নামকরণ হয়। কিন্তু ইদানীং চার পাশে বিষয়টা হাস্যকর ঠেকছে।’’ নিতান্তই ণত্ব-ষত্ববিহীন নাম বদলের হিড়িক অবশ্য অচেনা নয় কলকাতার। রেলমন্ত্রী থাকাকালীন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় যে-ভাবে বিভিন্ন মেট্রো স্টেশনের নাম রাখছিলেন, তাতে ভড়কে যান নিত্যযাত্রীরাও। মুখ্যমন্ত্রী মমতাও নামকরণে তৎপর। রাস্তার নাম সরণি রাখার পরম্পরাও ভেঙেচুরে তিনি ‘সত্যজিৎ রায় ধরণী’ করেছেন। মমতার উড়ালপুলের নাম ‘মা’, আলিপুরের ‘অ্যাম্ফিথিয়েটারের নাম ‘উত্তীর্ণ’! বাম আমলের লেনিন সরণি নামটি তবু ওই তল্লাটের নানা বামমনস্ক রাজনৈতিক আন্দোলনের সূত্রে ব্যাখ্যা করা যেতে পারে, কিন্তু কোন সম্পর্কের ভিত্তিতে খিদিরপুরে কার্ল মার্ক্স সরণি হল, বোঝা শক্ত।
‘‘সব জমানাতেই পছন্দমাফিক নামকরণের প্রবণতা দেখা যায়। তবে বিজেপি সেটাকে হাস্যকর পর্যায়ে নিয়ে গিয়েছে,’’ বলছেন প্রাক্তন আইএএস অফিসার জহর সরকার। পোর্ট ব্লেয়ার বিমানবন্দরকে বীর সাভারকরের নামে চিহ্নিত করার পরে কলকাতা বন্দরে শ্যামাপ্রসাদকে জড়ানো হয়েছে। জহরবাবুর কথায়, ‘‘আসলে বরণীয় দেশনেতাদের মধ্যে বিজেপির মতাদর্শের লোক তো পাওয়াই যায় না! যাঁদের নাম ওঁরা ব্যবহার করছেন, তাতে নিজেদের দৈন্যই বেশি প্রকট হয়ে উঠছে।’’