—নিজস্ব চিত্র।
সুস্থ হয়ে, যত তাড়াতাড়ি সম্ভব অধিবেশনে যোগ দেব— লিখছেন সুব্রত মুখোপাধ্যায়। এসএসকেএম হাসপাতালে বসে নিজে হাতে লিখে গত সোমবার এই চিঠিই পাঠিয়েছিলেন বিধানসভার স্পিকার বিমান বন্দ্যোপাধ্যায়ের কাছে।
চার দিনের মাথায় শুক্রবার তিনি এলেন বিধানসভায়। কাচের গাড়িতে। সে গাড়ি তাঁকে নিয়ে ফিরেও গেল। তবে অধিবেশন নয়, প্রয়াত পঞ্চায়েতমন্ত্রীর এই যাত্রা ছিল চিরবিদায়ের। সদালাপী, হাসিমুখ সুব্রতের সেই চিঠিই ছিল এ দিনের শোকবিহ্বল বিধানসভার চর্চায়। বিধায়কের লেটারহেড-এ ঝরনা কলমে স্পিকারের উদ্দেশে তিনি লিখেছেন, ‘হৃদরোগের চিকিৎসার জন্য আমি এসএসকেএম-এ ভর্তি হয়েছি। সুস্থ হয়ে যত দ্রুত সম্ভব আমি এ বারের অধিবেশনে যোগ দেব।’
প্রয়াত নেতার চিঠির প্রসঙ্গে স্পিকারও ছিলেন আবেগতাড়িত। তিনি বলেন, ‘‘এত দিনের বিধায়ক, প্রবীণ মন্ত্রী। তবু তাঁর কাছে বিধানসভার যে কতটা গুরুত্ব ছিল, ওই চিঠিই তার প্রমাণ।’’ তিনি বলেন, ‘‘ভেবেছিলাম, হাসপাতাল থেকে ছুটি পাওয়ার পরে হয়ত অধিবেশনের শেষ দিকে দু-এক দিন থাকতে পারবেন। তা আর হল না!’’
স্মৃতি: দরজার বাইরে নামফলক। —নিজস্ব চিত্র।
বিধানসভার কাজকর্ম নিয়ে একাধিক বার স্পিকারের সঙ্গে নানা আলোচনা করেছেন সুব্রত। স্পিকারের কথায়, ‘‘এই নতুন বিধানসভায় এক দিন তো খুব রাগারাগি করে গেলেন। বললেন, পঞ্চায়েত- গ্রামোন্নয়ন দফতরের মতো গুরুত্বপূর্ণ দফতর। এত কম সময়ে এ সব নিয়ে আলোচনা হয়?’’
পঞ্চাশ বছরের পরিষদীয় জীবন। রাজনীতিতে আরও কিছুটা বেশি সময়। এক দিকে জঙ্গিনেতা, অভিজ্ঞ প্রশাসক আর এক দিকে চটুল রাজনৈতিক মন্তব্য— এই রকম বৈপরীত্যে ভরা ‘সুব্রতদা’কে ঘিরে রাজনীতির যে পরিবেশ অর্ধশতকে প্রতিষ্ঠা পেয়েছিল, এক বেলায় তা একেবারে বদলে গিয়েছে। বিধানসভার অধিবেশন চলাকালীন এত দিন যে সুব্রতকে ঘিরে কখনও লবিতে, কখনও গাড়ি বারান্দায় ছোট ছোট জটলা তৈরি হয়েছে, এ দিন তা ভিড় হয়ে ভেঙে পড়েছে ফুলের বিছানায় শোয়ানো তাঁর দেহ ঘিরে। হাসিঠাট্টা আর রাজনীতি বা প্রশাসনের গম্ভীর কথাবার্তা ছিল না। সেই ভিড়ের মধ্যে থেকে মাঝেমধ্যে কান্না ভেসেছে প্রয়াত নেতাকে ঘিরে।
বিধানসভার ভিআইপি করিডোরে ২৪ নম্বর ঘর বরাদ্দ ছিল পঞ্চায়েত মন্ত্রী সুব্রতের। মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের ঘরের পরে শিল্পমন্ত্রী পার্থ চট্টোপাধ্যায়ের ঘর। তার ঠিক পরে এই ঘরেও এ দিন ছিল বিষাদের ছায়া। বন্ধ দরজার পাশে পিতলের প্লেটে লেখা নাম দেখে দীর্ঘশ্বাস ফেলেছেন সতীর্থেরা। অধিবেশন চলাকালীন এই ঘরগুলির মধ্যেই তো কত কিছু চালাচালি হয়েছে। সে কথা মনে করে নিরাপত্তা বিভাগের কর্মী ভোলা মুখোপাধ্যায় বলেন, ‘‘পঞ্চায়েতমন্ত্রী তো মিষ্টি পেলে আর কিছু চাইতেন না। অধিবেশনের সময় মুখ্যমন্ত্রী এলে গুড়-বাদাম বা ওই জাতীয় খাবার বহু বার পাঠিয়েছেন তাঁর কাছে।’’
দরজার ভিতরে গোছানো ছিমছাম ঘরের প্রতিটি কোন এ দিনও প্রয়াত নেতার মতো পরিপাটি। কাচের ঝকঝকে জলের গ্লাসটিও ঢাকা দেওয়া কোস্টারে। ঘর জুড়ে অপেক্ষা, যা অনন্ত হয়ে থাকবে।