—ফাইল চিত্র।
সুব্রত মুখোপাধ্যায়ের সঙ্গে আমার পরিচয় হয় বিংশ শতকের আটের দশকে। ১৯৮২ থেকে ১৯৮৭ সালের মাঝামাঝি পর্যন্ত আনন্দবাজার পত্রিকা থেকে পশ্চিমবঙ্গ বিধানসভায় যারা রিপোর্টিং করতে যেত, আমি তাদের মধ্যে তরুণতম ছিলাম। সেই সুবাদে সুব্রতবাবু আমাকে খানিকটা স্নেহ করতেন। বিধানসভায় তিনি তখন বিরোধী নক্ষত্র, আমাদের সযত্নে শেখাতেন পরিষদীয় জটিলতার খুঁটিনাটি।
প্রশাসনে তাঁর সঙ্গে আমার যোগাযোগ সাধিত হল এই শতকের গোড়ায়। সুব্রতবাবু তখন কলকাতা পুরসভার মেয়র, সিনিয়র আইএএস দেবাশিস সোম তাঁর কমিশনার, আমি কেএমডিএ-র সিইও (মুখ্য নির্বাহী আধিকারিক)। পৌর উন্নয়নের নানা বিষয়ে আমাদের দু’জনকে নিয়ে সুব্রতবাবু মিটিং করতেন, পুরসভার সঙ্গে কেএমডিএ-র সমন্বয় যাতে অব্যাহত থাকে সে বিষয়ে দৃষ্টি দিতেন। ২০০৫ সালে সুব্রতবাবু কলকাতা পুরসভা থেকে চলে যান, দেবাশিস সোমও অন্য পদে স্থানান্তরিত হন। দেবাশিসদার জায়গায় তখন আমি পুর কমিশনার হই। বছর চারেক কলকাতায় কমিশনার হিসেবে কাজ করার সূত্রে আমার মূল্যায়ন হল, সুব্রতবাবু মেয়র হিসাবে মহানগরে সাফল্যের স্বাক্ষর রেখেছিলেন। বিশেষত, সম্পত্তি কর নির্ধারণ ও বকেয়া কর আদায়ের ক্ষেত্রে তাঁর কড়া মনোভাব খুব সুফল দিয়েছিল। তার আগে সম্পত্তি কর আদায় করার ব্যাপারে পুরসভা একটু ঢিলেঢালা ছিল। তিনি ছোটখাটো বিঘ্ন বা হস্তক্ষেপকে দূরে সরিয়ে অফিসারদের এতটাই স্বাতন্ত্র্য দিয়েছিলেন যে, অ্যাসেসমেন্ট-কালেকশন বিভাগের অফিসাররা রীতিমতো গর্বিত বোধ করতেন পুরসভার আধিকারিক হিসেবে। এই স্বাতন্ত্র্যবোধ এবং গর্বই তাঁদের কর্মসংস্কৃতির মোড় ঘুরিয়ে দেয়। আবার, টাকা আদায় তো উপায় মাত্র। যেহেতু পুরসভায় রোজগার বাড়ে, সেহেতু তাঁর সময়ে কিছু বড় প্রকল্পও পুরসভা হাতে নিতে পারে। সরকারি বাজেটের সীমাবদ্ধ অনুদানের বাইরে গিয়েও যে নিজস্ব তহবিলের জোরে বড় বড় স্কিমে হাত দেওয়া যায়, সেটা সুব্রতবাবুর সময়েই কলকাতা পুরসভা প্রথম ভাল ভাবে বুঝতে পারে। এই নতুন প্রকল্পগুলির মধ্যে অধিকাংশই ছিল পানীয় জল সংক্রান্ত। মহানগরে শুদ্ধ পানীয় জল উৎপাদন ও বণ্টনের ক্ষেত্রে সুব্রতবাবু অনেকগুলি সুদূরপ্রসারী কর্মসূচি নিয়েছিলেন।
নিকাশি ও সলিড ওয়েস্ট ম্যানেজমেন্টের ক্ষেত্রেও কলকাতায় তাঁর সময়ে তাৎপর্যপূর্ণ অগ্রগতি হয়েছিল। মহানগরের নতুন এলাকাগুলিতে (অ্যাডেড এরিয়া) পৌর পরিষেবায় খামতি ছিল, পরিকাঠামোয় অসম্পূর্ণতা ছিল। এশিয়ান ডেভেলপমেন্ট ব্যাঙ্কের সহযোগিতায় এই সব ক্ষেত্রে কাজের সূচনা হয়েছিল সুব্রতবাবুর আমলে।
২০১১ সালে সুব্রতবাবুকে আমরা পেলাম রাজ্যের মন্ত্রী হিসেবে। ক্যাবিনেটে, মুখ্যমন্ত্রীর উচ্চস্তরের কোনও মিটিংয়ে, জেলাস্তরে প্রশাসনিক বৈঠকে, যে-কোনও পর্যালোচনায় তাঁর উপস্থিতি ছিল অগ্রণী ও উল্লেখযোগ্য। কিন্তু অফিসারদের সবচেয়ে ভাল লাগত তাঁর সহাস্য ও সুমধুর ব্যবহার। জেলার প্রশাসনিক বৈঠকগুলিতে মুখ্যমন্ত্রীর একটু আগেই তিনি মঞ্চে এসে যেতেন— সব অফিসারের সঙ্গে হালকা কথাবার্তা সেরে নিয়ে, সকলের সঙ্গে সৌজন্য-বিনিময় করার পর তবেই তিনি নিজের নির্দিষ্ট আসনে বসতেন। এতে টিম-বিল্ডিংয়ে সুবিধা হত।
জেলায় মুখ্যমন্ত্রীর প্রশাসনিক বৈঠকগুলিতে সুব্রতবাবুর বিশেষ অংশগ্রহণ দেখা যেত প্রশ্নোত্তর পর্বে। এই সব বৈঠকে পঞ্চায়েত ও গ্রামোন্নয়নের নানা স্কিম নিয়ে অফিসারদের প্রতি মুখ্যমন্ত্রীর বিভিন্ন প্রশ্ন থাকে। মানুষের কাছে স্কিমের সুযোগ-সুবিধা ঠিক মতো পৌঁছেছে কি না, সেই সূত্রেই প্রশ্নাবলি। সাধারণ ভাবে, সচিব বা জেলা শাসকেরই ওই সব প্রশ্নের উত্তর দেওয়ার কথা— কিন্তু নিজ দফতরের ক্ষেত্রে সুব্রতবাবুই এগিয়ে এসে সব উত্তর দিতে চাইতেন। তাঁর তথ্যভিত্তিক, স্পষ্ট এবং হাসিখুশি উত্তরগুলি আমাদের এই সব বৈঠকের মর্যাদা বৃদ্ধি করত।
আমাদের মধ্যে সৌরভ ছিল তাঁর সবচেয়ে ঘনিষ্ঠ। সৌরভ মানে সৌরভ দাস, তখন পঞ্চায়েত ও গ্রামোন্নয়ন বিভাগের ভারপ্রাপ্ত অতিরিক্ত মুখ্যসচিব — মন্ত্রী সুব্রত মুখোপাধ্যায়ের বিভাগীয় দক্ষিণহস্ত। কাজের যোগসূত্র কী ভাবে পারিবারিক ঘনিষ্ঠতায় পরিণত হতে পারে এবং তাতে কী ভাবে কাজের সুবিধা হতে পারে, সেটা ওঁদের দেখে বুঝতাম। সুব্রতবাবু এবং সৌরভ দাস পরস্পরকে সত্যিই ভালবেসে ফেলেছিলেন। দার্জিলিং পাহাড়ে যে বার সুব্রতবাবু অসুস্থ হয়ে পড়লেন, সে বার মুখ্যমন্ত্রীর কথায় সৌরভ তার মন্ত্রীর পরিচর্যায় বিশেষ যত্ন নিয়েছিল। সৌরভের বন্ধু হিসেবে আমরাও সুব্রতবাবুর উষ্ণতা পেতাম, জেলা-মহকুমায় মুখ্যমন্ত্রীর পর্যালোচনা সেই উষ্ণতায় অন্য মাত্রা পেত।
সুব্রতবাবুর একটা প্রিয় বিষয় ছিল গঙ্গাসাগর মেলা। জনস্বাস্থ্য কারিগরি দফতরের মন্ত্রী হিসেবে মেলার অনেকটা ভার তাঁরই হাতে ছিল। তা ছাড়া মুখ্যমন্ত্রীও মেলার ব্যাপারে তাঁর উপর বিশেষ ভরসা করতেন। মকর সংক্রান্তির সময় সাগরসঙ্গমে তাঁর উপস্থিতি উজ্জীবিত করত শত শত পুণ্যার্থীসেবী স্বেচ্ছাসেবী সংস্থাকেও।
সদাহাস্য, স্নেহময় সুব্রতবাবুর প্রয়াণে রাজ্যের অফিসাররা এক জন বিচক্ষণ অভিভাবককে হারালেন। জনাদেশপ্রাপ্ত মন্ত্রীরাই একমাত্র যন্ত্রী এবং পরীক্ষাপথে আগত আমলারা যন্ত্র মাত্র — এই ভেদভাব প্রশাসনে চলে না। আসলে যে মন্ত্রীরা ভালবেসে সহকর্মীদের দিয়ে কাজ করিয়ে নিতে পারলেই মানুষের লাভ হয়— এইটা বোঝা দরকার। সুব্রতবাবু এটা বুঝতেন এবং সে জন্যই তাঁর অভাব অনুভূত হবে।