Bengal Football Team

‘ওর বাবা এটা দেখে যেতে পারল না’! আনন্দাশ্রুর মধ্যেই আক্ষেপ করছেন ‘নায়ক’ রবির ক্ষেতমজুর মা

হৃদ্‌রোগে আক্রান্ত হয়ে মৃত্যু হয় রবি হাঁসদার বাবার। তার পর থেকেই একার হাতে সংসার টানেন তুলসী। সংসারে টানাটানি থাকলেও রবিকে কখনও বুঝতে দেননি অভাবের কথা। সেই মায়ের মুখে হাসি ফোটালেন রবি।

Advertisement

আনন্দবাজার অনলাইন সংবাদদাতা

শেষ আপডেট: ০৩ জানুয়ারি ২০২৫ ২০:৪২
Share:

(বাঁ দিকে) তুলসী হাঁসদা এবং বাংলার ফুটবলার রবি হাঁসদা (ডান দিকে)। —নিজস্ব চিত্র।

বাবা ফুটবলপ্রেমী ছিলেন। তাই চাইতেন ছেলেও বড় হয়ে ফুটবল খেলুক, নাম উজ্জ্বল করুক! সেই স্বপ্ন বুনেছেন। সেই মতো নিজের পুত্রকে তৈরি করেছেন। কিন্তু পুত্রের সাফল্য দেখে যেতে পারেননি সুলতান হাঁসদা। স্বামীর স্বপ্নপূরণে এগিয়ে আসেন তুলসী। পুত্র ফুটবল নিয়ে ব্যস্ত। স্বামীর মৃত্যুর পর সংসার চালানোর সব দায়িত্ব একার কাঁধেই তুলে নেন তুলসী হাঁসদা। কষ্ট বুঝতে দেননি পুত্রকে। ক্ষেত মজুরি করে উপার্জন করা টাকা তুলে দিতেন পুত্রের হাতে। মাকে নিরাশ করেননি পুত্র রবি হাঁসদা। সন্তোষ ট্রফি জয়ী বাংলা দলের অন্যতম সদস্য রবি এখন সকলের নয়নের মণি! হবে নাই বা কেন, গোটা টুর্নামেন্টে সবচেয়ে বেশি গোল এসেছে তাঁর পা থেকেই।

Advertisement

রবির বাড়ি পূর্ব বর্ধমানের মঙ্গলকোট থানার অন্তর্গত মশারু গ্রামের আদিবাসী পাড়ায়। দোতলা মাটির বাড়িতেই সংসার রবিদের। সেই সংসারে তুলসী, রবি ছাড়াও আছেন তাঁর স্ত্রী এবং এক শিশুকন্যা। দিদির বিয়ে হয়ে গিয়েছে। মাস ছয় আগে এই বাড়িতেই থাকতেন সুলতান। হৃদ্‌রোগে আক্রান্ত হয়ে মৃত্যু হয় তাঁর। তার পর থেকেই একার হাতে সংসার টানেন তুলসী। সংসারে টানাটানি থাকলেও রবিকে কখনও বুঝতে দেননি অভাবের কথা। সেই মায়ের মুখে হাসি ফোটালেন রবি।

স্থানীয় সূত্রে খবর, সুলতান ফুটবল ভালবাসতেন। তাই রবিও খুব ছোট বয়স থেকে ফুটবল খেলায় আকৃষ্ট হয়ে পড়েন। ফুটবল পায়ে দৌড়াদৌড়ি করে বেড়াতেন রবি। একটু বড় হতেই ফুটবল খেলায় দক্ষতা অর্জনের জন্য রবি বলগোনা থেকে ভাতারে গিয়ে ফুটবল খেলা শুরু করেন। প্রশিক্ষণ নেওয়া শুরু করেন ভাতার একাদশ ক্লাবের তৎকালীন ফুটবল প্রশিক্ষক মুদরাজ সেডেনের কাছে। তাঁর হাত ধরেই রবির ফুটবল জীবনের ভাগ্য বদলাতে শুরু করে।

Advertisement

মুদরাজের কাছে কয়েক বছর প্রশিক্ষণ নিয়ে রবি ফুটবল খেলায় বেশ দক্ষ হয়ে ওঠেন। কাস্টমসের হয়ে খেলে সাফল্য দেখিয়ে ২০১৭ সালে অনুর্ধ্ব-১৯ বাংলা দলের হয়ে খেলার জন্য ডাক পান তিনি। ট্রায়ালে নির্বাচিত হন। পরে অধিনায়কত্বও পান। ২০২২ সালে ন্যাশনাল গেমসে পাঁচ গোল করে রবি তাক লাগিয়ে দেন। চ্যাম্পিয়ন হয় বাংলা। তার পর ২০২৩ সালে সন্তোষ ট্রফির বাছাই পর্বে খেলতে গিয়ে শুরুতেই হাঁটুতে চোট পান রবি। চোটের কারণে ওই বছরটা রবিকে মাঠের বাইরেই থাকতে হয়। চোট সারিয়ে ২০২৪ সালের শুরু থেকে মাঠে ফেরার লড়াইয়ে নামেন তিনি। কিন্তু সময়টা তাঁর ভাল যায় না। হঠাৎই হৃদ্‌রোগে আক্রান্ত হয়ে তাঁর বাবা মারা যান। পিতৃশোক কাটিয়ে আবার মাঠে নেমে কোচ সঞ্জয় সেনের কথা মতো অনুশীলন চালিয়ে গিয়ে রবি নিজেকে আগের মত দক্ষ করে তোলেন। সন্তোষ ট্রফিতে বাজিমাত করে ফেলেন রবি। বাংলার ফুটবল দল ভারত সেরা হতেই ফুটবলপ্রেমীদের মুখে মুখে এখন শুধুই ঘুরছে রবি হাঁসদার নাম।

পায়ে ফুটবল নিয়ে রবি বাংলার অগুনিত ফুটবলপ্রেমীদের মুখে হাসি ফোটালেও এখনও দারিদ্রতা ঘিরে রয়েছে রবির পরিবারকে। রবির বাবা টোটো চালিয়ে উপার্জন করতেন। এখন সংসার টানায় যাবতীয় দায় বর্তেছে রবির মার উপরে। রুটিরুজি জোগাড়ের জন্য তুলসীদেবীকে তাই এখন নিয়মিত ক্ষেতমজুরির কাজে যেতে হয়। উপার্জিত টাকা তুলে দেন রবির হাতে। কষ্ট করে সংসার চালিয়ে রবির ফুটবল খরচ জোগাড় করতেন তিনি। তাই আজ পুত্রের সাফল্যে মুখে হাসি ফুটেছে তুলসীদেবীর। তাঁর কথায়, ‘‘ওঁর (রবি হাঁসদা) সাফল্যে আমি আনন্দিত, গর্বিতও বটে। তবে দুঃখ লাগছে একটা কারণে। রবির বাবা ছেলের এই সাফল্য দেখে যেতে পারলেন না।’’ কথা বলতে বলতে চোখ ভিজে যায় কান্নার জলে।

তুলসীদেবী বলেন, “আমাদের পরিবারে নুন আনতে পান্তা ফুরানো অবস্থা। তাই আমাকে এখনও ক্ষেতমজুরির কাজে যেতে হয়। তা সত্ত্বেও রবি যাতে মস্ত ফুটবল খেলোয়াড় হয়ে তাঁর বাবার স্বপ্নপূরণ করতে পারে তাই সব কষ্ট আমি হজম করেছি। কোনও দিন পান্তা ভাত আবার কোনও দিন আধপেটা ভাত খেয়ে ভোরে রবি কলকাতার মাঠে প্রশিক্ষণে যেত। শত কষ্ট সহ্য করে খেলে গিয়ে রবি নিজের যোগ্যতার প্রমাণ দিয়েছে।’’

সন্তোষ ট্রফি জয়ী বাংলার ফুটবল দলে সকল খেলোয়াড়ররা এবং কোচের সঙ্গে বৃহস্পতিবার সন্ধ্যায় নবান্নে দেখা করেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। সেখানেই প্রত্যেক খেলোয়াড়ের জন্য ক্রীড়া দফতরে চাকরির কথা ঘোষণা করেন তিনি। মুখ্যমন্ত্রীর এই ঘোষণায় হাসি ফুটিয়েছে রবির মায়ের মুখে। তিনি বলেন, ‘‘শুনেছি মুখ্যমন্ত্রী চাকরির কথা বলেছেন। চাকরি পেলে আমাদের সংসারে খুব উপকার হবে। আমি মুখ্যমন্ত্রীর কাছে কৃতজ্ঞ।’’

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement