eductaion

স্কুলঘর রইল পড়ে, কাজের খোঁজে পড়ুয়ারা

বিক্রমডি গ্রামের জলধর কর্মকার গত বছর মাধ্যমিক পাশ করেছে। একাদশ শ্রেণিতে ভর্তিও হয়েছিল। কিন্তু পেট চলবে কী করে?

Advertisement

নিজস্ব প্রতিবেদন

কলকাতা শেষ আপডেট: ০৭ অগস্ট ২০২১ ০৭:৩৯
Share:

প্রতীকী ছবি।

চাকুলিয়া আর দিল্লির সকাল একটু আলাদা। ঘর ছেড়ে দেড় হাজার কিলোমিটার উজিয়ে এসে এটা বুঝতে পেরেছে নাজমুল হোসেন। এখানে বইখাতা নেই। মা এসে স্কুলে যাওয়ার তাড়া দেন না। গৃহশিক্ষক বলে যান না, অঙ্কগুলো যেন সন্ধ্যায় এসে পাই! যে জিন্স কারখানায় সে কাজ করে, সেখানে বরং চটপট ঢুকে পড়তে পারলে খুশি হন মালিক। নাজমুলও কাজে ফাঁকি দিতে চায় না। বাড়িতে থাকতে পড়াশোনাতেও সে বিশেষ ফাঁকি দিত না। এখানে এসেই যন্ত্রের শব্দ, বয়সে বড় সহকর্মীদের গুঞ্জনের মধ্যে সে বসে যায় প্যান্টে লেবেল সাঁটতে।

সে দিন তেমনই লেবেল সাঁটছিল সে। পাশে পড়েছিল বিজন বিভুঁইয়ের সঙ্গী স্মার্ট ফোন। হঠাৎ বেজে উঠল সেটি। নাজমুল দেখে, বাবার নম্বর। কানে লাগাতেই ওপাশ থেকে চাকুলিয়া হাইস্কুলের প্রধান শিক্ষকের গলা, ‘‘ভাল পাশ করেছিস নাজমুল। ৭৩ শতাংশ নম্বর পেয়েছিস মাধ্যমিকে।’’ মুখটা উজ্জ্বল হয়ে উঠেছিল ষোলো-সতেরো বছরের ছেলেটির।

Advertisement

মহারাষ্ট্রের রোহা পুরুলিয়া থেকে আরও বেশি দূরে। বিক্রমডি গ্রামের জলধর কর্মকার গত বছর মাধ্যমিক পাশ করেছে। একাদশ শ্রেণিতে ভর্তিও হয়েছিল। কিন্তু পেট চলবে কী করে? ‘‘বাবা কামারশালা চালিয়ে সামান্য রোজগার করেন। রেশনের চাল আর আটাটুকু ছিল বলে দু’বেলা কিছু জোটে। স্কুল বন্ধ দেখে কাজের খোঁজ করছিলাম। এক জন সন্ধান দিতেই চলে এলাম,’’ ফোনে জানাল সে। ছ’মাস ধরে তার এটাই ঠিকানা।

বীরভূমের অনুশ্রী রাজবংশীর বাবা দশ বছর নিরুদ্দেশ। মা বহু কষ্ট করে এত দিন পড়িয়েছেন। পাইকর গ্রামের মেয়েটি এ বারে মাধ্যমিক পাশ করেছে। বই কেনার সামর্থ্য নেই। সে মায়ের সঙ্গে হাত লাগিয়েছে বিড়ি বাঁধার কাছে। তার কথায়, ‘‘অনলাইনে পড়াশোনা আমাদের জন্য নয়। স্কুল খুললেও আর যাব কিনা, জানি না।’’

Advertisement

অনুশ্রীর সঙ্গে অবশ্য একমত নয় নাজমুল বা জলধর। তারা এখনও পড়তে চায়। নাজমুল বলে, উচ্চ মাধ্যমিক পড়ার টাকাটা জোগাড় হলেই সে ঘরে ফিরবে। উচ্চ মাধ্যমিক পরীক্ষা দিতে চায় জলধরও।

কিন্তু এই ‘চাওয়ার’ সঙ্গে ‘পাওয়ার’ ফারাক কতটা?

প্রায় দেড় বছর ধরে যে স্কুলগুলি বন্ধ, যেখানকার পড়ুয়াদের অনেকেই ভুলতে বসেছে পড়াশোনা, বদলে জীবন তাদের জুতে দিয়েছে উপার্জনে, যেখানে অনলাইন ক্লাস থেকে মিড ডে মিলের সঙ্গে টাস্ক দিয়েও এক চুল এগনো যায়নি বিদ্যাচর্চা, সেখানে ইচ্ছে ও বাস্তবের এই ফারাক মেটাতে কি পারবে নাজমুল বা জলধর?

তাই যদি হবে, তবে কেন মোটে সাড়ে চার বছর বয়সী এক শিশুকে বসতে হয় বাবার চায়ের দোকানে? এ পশ্চিম বর্ধমানের নুপূর গ্রামে জগন্নাথ বাউড়ির ঘরের কথা। সেই গ্রামেরই হিন্দু মুর্মুর তৃতীয় শ্রেণিতে পড়া মেয়ে, বিশু হাঁসদার চতুর্থ শ্রেণিতে পড়া মেয়েরাই বা কেন চাষের কাজে মাঠে যাবে? ঘরে ঘরে সন্ধ্যায় কুলুঙ্গি থেকে বইপত্তর আর নামছে কই?

নাম শুধু নাজমুল আর জলধরে আটকে নেই। হাওড়ার জগদবল্লভপুরের পঞ্চা নায়েক, শেখ সামির আলি, শেখ সাইদুল, বিক্রম রায়চৌধুরী, পুরুলিয়ার বামুনডিহা গ্রামের ননীগোপাল মাহাতো, নদিয়ার গয়েশপুরের দেবায়ন বালাদের খোঁজ করতে গেলেও জবাব মিলছে, নেই। করোনার প্রথম প্রবাহের পরেই এদের বেশিরভাগ চলে গিয়েছে ভিন্ রাজ্যে। বেশ কিছু ছেলেমেয়ে আবার দেশ-গাঁ ছেড়ে চলে যাচ্ছে কলকাতাতেও, রোজগারের লক্ষ্যে।

এই বহির্মুখী স্রোতকে আটকে স্কুল প্রাঙ্গণে ফেরানো কি সম্ভব?

বেশিরভাগ জেলার স্কুল পরিদর্শকই জানিয়েছেন, স্কুলঘরে যেখানে তালা, সেখানে কে বাড়িতে কী করছে, তা নিয়মিত খোঁজ নেওয়া কঠিন। মুর্শিদাবাদ থেকে সব থেকে বেশি হারে মানুষ ভিন্ রাজ্যে কাজে যান। সেই জেলার স্কুল পরিদর্শক (মাধ্যমিক) অমরকুমার শীল বলেন, ‘‘পড়ুয়াদের তো স্কুলে আসার অনুমতি নেই। ফলে তারা বাড়িতে কী করছে, সে খবর আমাদের কাছে নেই। স্কুল চালু হলে বোঝা যাবে, কেউ পড়াশোনা ছেড়ে দিল কিনা।’’ ১৮ বছর পর্যন্ত স্কুলছুটদের তালিকা তৈরি করতে ২০১২ সাল থেকে চাইল্ড রেজিস্টার হচ্ছে। কিন্তু গত বছর থেকে এই সমীক্ষার কাজ বন্ধ। তা হলে সঠিক সংখ্যা জানা যাবে কী ভাবে?

শিক্ষকরাও মানছেন, এই ঢেউ আটকানো কঠিন। বাঁকুড়ার এক স্কুল শিক্ষক বলেন, ‘‘ট্যাব দেওয়ার জন্য পড়ুয়াদের ব্যাঙ্কের তথ্য চাওয়া হয়েছিল। তখন একটি ছাত্র তার মাকে পাঠায়। সন্দেহ হতে জিজ্ঞাসাবাদ করি। জানা যায়, কয়েক মাস আগেই ছেলেটি বাইরের রাজ্যে কাজে চলে গিয়েছে।’’ আলিপুরদুয়ারের মাদারিহাট হাই স্কুলের প্রধান শিক্ষক নারায়ণচন্দ্র সরকার বলেন, ‘‘আমাদের স্কুলের পরীক্ষার্থীদের মধ্যে সব ছাত্রীই মাধ্যমিকের মার্কশিট নিয়ে গিয়েছে। চার জন ছাত্র শুধু আসেনি। খোঁজ নিয়ে জানতে পারি, ভিন্ রাজ্যে রয়েছে তারা।’’ ঝাড়গ্রামের বিনপুরের একটি স্কুলের এক শিক্ষক বলেন, ‘‘নিম্ন ও মধ্য মেধার এক শ্রেণির পড়ুয়া প্রায় দু’বছর বাড়িতে বসে থাকায় তাদের পড়াশোনার চর্চাটাই নষ্ট হয়ে গিয়েছে। নবম শ্রেণির পড়ুয়ারা স্কুলে রেজিস্ট্রেশন করাতে এসে ইংরেজিতে সই অবধি করতে পারছে না।’’

কিন্তু কী ভাবে তাদের চর্চায় ফিরিয়ে আনা হবে? জবাব হারিয়ে যায় নাজমুলের জিন্স কারখানায় যন্ত্রের খটাখট শব্দে।

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement