সংগ্রহ: কুড়িয়ে আনা পতাকা নিয়ে মনু। নিজস্ব চিত্র
ভোর হতেই তিনি বেরিয়ে পড়েন। নিজের পাড়া ছাড়িয়ে অন্য এলাকার রাস্তায় ঘুরতে ঘুরতে বিকেল গড়িয়ে যায়। তাও থামেন না বছর ৩২-এর যুবক। সাইকেল থামান তখনই, যখন রাস্তা, নর্দমা বা ঝোপে জাতীয় পতাকা পড়ে থাকতে দেখেন। সেই তেরঙা নিজের হাতে তুলে পিঠের ব্যাগে ঢুকিয়ে রাখেন তিনি।
এ ভাবেই প্রায় ১২ বছর ধরে প্রতি স্বাধীনতা দিবস ও প্রজাতন্ত্র দিবসের পরের দিন রাস্তা থেকে পতাকা কুড়িয়ে নিয়ে আসেন প্রিয়রঞ্জন সরকার। বালি নিশ্চিন্দার বাসিন্দা ওই যুবককে বেশির ভাগ লোকই চেনেন মনু নামে। কেউ আবার ঠাট্টা করে বা টিপ্পনি কেটে ডাকেন, কাগজকুড়ানি। দুঃখ পান না মনু। বললেন, ‘‘নিজের মা যদি রাস্তায় পড়ে থাকতেন, তা হলে তাঁকেও তো তুলে আনতাম। জাতীয় পতাকাও তো মা, তাকে তুলে আনলে কেউ যদি কটূক্তি করেন, করুন।’’ খুব ছোট বয়সে বাবাকে হারিয়েছেন মনু। মা আভাদেবীই কষ্ট করে বড় করেছেন ছেলেকে। স্পষ্ট করে কথা বলতে পারেন না মনু। তবুও পতাকা কুড়োনোর সময়ে লোকজনকে জাতীয় পতাকার গুরুত্ব, সম্মান বোঝানোর চেষ্টা করে যান। কেউ যে বোঝেন না, তা-ও নয়। সেচ দফতরের কর্মী মনু জানান, পতাকা কুড়োনোর কাজে তাঁকে সহযোগিতা করতে এগিয়ে আসেন অনেকেই। বর্ধমান, শ্রীরামপুর থেকে শুরু করে হাওড়ারও বিভিন্ন এলাকার তরুণ-তরুণীরা মনুর সঙ্গী হয়ে ওই দু’দিন রাস্তায় নামেন। কখনও তাঁকে সঙ্গ দেন বিভিন্ন ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানের সন্ন্যাসী থেকে এলাকার চিকিৎসক, শিক্ষকেরা। সকলেই পতাকা সংগ্রহ করে তুলে দেন মনুর হাতে।
১২ বছর ধরে জমানো পতাকা রাখেন কোথায়? ২০ ফুট বাই ১৫ ফুটের একটি টিনের বাক্স দেখিয়ে মনু বলেন, ‘‘প্রায় ১৪-১৫ হাজার পতাকা এই বাক্সে ভরে রেখেছি। যাতে পোকায় না কাটে, তার জন্য ন্যাপথালিন দিয়ে রাখি।’’
আরও পড়ুন: আয়ের পথ খুঁজতে জমি ব্যবহার রেলের
কী ভাবে শুরু করলেন পতাকা কুড়োনোর কাজ? ওই যুবক জানান, বহু আগে স্বাধীনতা দিবসের পরের দিন কয়েকটি পতাকা রাস্তা থেকে কুড়িয়ে নিয়েছিলেন আভাদেবী। বছর ছয়েকের মনু কারণ জানতে চাওয়ায় আভাদেবী বুঝিয়েছিলেন, তাঁর মতো ওই পতাকাও মনুর মা। পতাকার সম্মান রক্ষা করা সকলের দায়িত্ব। মায়ের সেই কথা মনে রেখেছিলেন মনু। কলেজ থেকে পাশ করে তিনিও ফেলে দেওয়া পতাকা সংগ্রহের কাজ শুরু করেন।
১৫ অগস্ট বা ২৬ জানুয়ারিতে বহু অনুষ্ঠানে জাতীয় পতাকার ব্যবহার হয়। কিন্তু পরের দিন সেগুলি রাস্তায়, নর্দমায় পড়ে থাকে। বেশির ভাগ মানুষেরই সে দিকে হুঁশ থাকে না। মনু প্রথমে সেই সব পতাকা তুলে এনে বাড়ির একতলায় অব্যবহৃত একটি রান্নাঘরে জমিয়ে রাখতেন। আবর্জনা লাগা সেই পতাকা থেকে দুর্গন্ধ বেরতো। তাই তাতে ন্যাপথালিন দিয়ে রাখতে শুরু করেন তিনি। কয়েক বছর আগে হকারদের মালপত্র রাখার বাক্স দেখে নিজেই মিস্ত্রি দিয়ে একটি বিশাল টিনের বাক্স বানিয়ে নেন। কোথা থেকে কতগুলি পতাকা তুলে আনছেন, তা চিরকুটে লিখে রেখে দেন বাক্সে।
কিন্তু এই বাক্সও তো ভরে যাবে এক সময়ে? মনু বলেন, ‘‘তখন নতুন বাক্স আসবে। এখন অনেকেই বুঝেছেন কেন আমি এমন করি। তাই আমি মরে গেলেও এই কাজ তো থামবে না।’’