কল্পনা রায় ও তাঁর স্বামী। ছবি: দীপঙ্কর ঘটক
‘আই মোর কইলে দুঃখ ফুরায় না/পিরিতি এক অউদগা ভাবনা।’
পিরিতির তিলক কেটে, কণ্ঠী বদল করে এক সময়ে সংসারী হয়েছিলেন কল্পনা রায়। এখনও সেই তিলক, কণ্ঠী রয়েছে। কিন্তু সে শ্বশুরঘর আর নেই।
জটিলেশ্বর মন্দিরের সামনে দাঁড়িয়ে পুজোর সামগ্রী বিক্রি করেন কল্পনা। চুলে পাক ধরেছে। চোখে চশমা উঠেছে। সস্তা ছাপা শাড়িতে জেল্লা আর ফেরেনি। ফুল, ধূপকাঠি একটা প্লাস্টিকের প্যাকেটে ভরে সঙ্গে গাঁদা, বেলপাতায় সাজানো ঘট নিয়ে ঘুরছেন তিনি। তাঁর মতো আরও অনেকে ঘুরছেন ঠা ঠা ফাল্গুনের রোদে।
কল্পনা শোনাতে থাকেন— এখানে এই মন্দিরের চৌকিদার ছিলেন তাঁর শ্বশুর ধরণীমোহন রায়। মন্দির সংলগ্ন এলাকায় তাঁদের বিস্তর জমি ছিল। কিন্তু যে-ই কংগ্রেস আমল ঘুচে বামফ্রন্ট এল, চৌকিদারিও শেষ। এখন এই ফুল, বেলপাতা আর ঘট বেচে কোনওমতে দিন চলে। কল্পনার সঙ্গে কথা বলতে দেখে এগিয়ে এলেন তাঁর স্বামী। স্ত্রীকে জিজ্ঞাসা করেন, কিছু বিক্রি হল? জবাব শুনে চুপ করে পাশটিতে গিয়ে ফের বসে পড়লেন।
এখানে, কয়েক শতাব্দী পুরনো এই জটিলেশ্বর শিবের মন্দিরে ফাগুন হাওয়ার মতো উড়তে থাকে কল্পনার কাহিনি। তাঁর একার কথা শুধু নয়। তাঁর সঙ্গেই ফুল, ধূপকাঠি বিক্রি করছেন যাঁরা, সেই শ্যামলী রায়, অশোক সরকার, বীরেন্দ্রনাথ রায়দেরও কষ্টের বারোমাস্যা ঘুরে ঘুরে ফেরে চারদিকে। জটিলেশ্বরের বটগাছে বাঁধা মানতের লালসুতো আর পাথরের মতো মরিয়া, অসহায় বীরেন বলেন, ‘‘একটা চাকরি দেন না জোগাড় করে!’’
‘...পিরিতি এক অউদগা ভাবনা!’
হাতে হাত রেখে ঘুরছেন এক যুগল। হাসছেন। মোবাইলে ছবি তুলছেন। ঢোকার পথে তাঁদের ঘিরে দাঁড়ালেন কল্পনা, বীরেন, শ্যামলীরা, ‘‘একটা প্যাকেট নিয়ে যান। মোটে তো ৫০ টাকা।’’ এত জনকে একসঙ্গে দেখে হকচকিয়ে গেলেন তাঁরা। তার পর কোনও মতে তাঁদের হাত এড়িয়ে চলে গেলেন ভিতরে। প্রৌঢ় শ্যামলী বলেন, ‘‘কত টাকার বিক্রি হয় বলুন!’’
মন্দিরের পাশে দিঘি, ভরে আছে কচুরিপানায়। কী আশ্চর্য, তাতেও ভর্তি হয়ে আছে পরিযায়ী পাখি! সে দিকে তাকাতে বীরেন বলে ওঠেন, ‘‘বালি হাঁস তো, এ বারে অনেক এসেছে। ওই কচুরিপানায় যে কী খাবার পায় ওরা, কে জানে!’’
চটকা গানের সুরে পিরিতি বেজে ওঠে জলপাইগুড়ির এই গ্রামে। চূড়াভাণ্ডার। কিন্তু বীরেন, কল্পনাদের তো ‘কইলে দুঃখ ফুরায় না’, পিরিতির অউদগা (ভিন্ন বা আলাদা) ভাবনা তাঁদের মনে বাজবে কী করে?
এই গ্রামের পাশের মাঠে সভা থেকে হাইকোর্টের সার্কিট বেঞ্চ চালু করেছিলেন প্রধানমন্ত্রী। গ্রামটিতে ঢোকার আগে যে ঝকঝকে চার লেনের জাতীয় সড়ক, তার এক প্রান্ত যদি যায় জলঢাকার দিকে, তবে অন্য প্রান্ত গিয়েছে সেই সার্কিট বেঞ্চের শহর জলপাইগুড়ির পাশে থাকা তিস্তায়। এই চূড়াভাণ্ডার গ্রামে তিস্তার প্রভাবই বেশি। ওই যে গ্রাম সড়কের কাজ চলছে এখন, তার ধারে বিপুল সাদা বালি তো তিস্তার বুক ছেঁচেই আনা। তাতেই কাঁচা পথ পাকা হচ্ছে।
কাজের জন্য ত্রিপল খাটিয়েছেন ঠিকাদারের লোকজনেরা। বাতি টাঙাতে বাঁশ পোতা হচ্ছে। তাঁদের সাহায্য করছেন উপেন বর্মণ। পাশেই তাঁর টিনের ঘর। রোগাভোগা মানুষটা খালি গায়ে খেটো ধুতি পরে প্রাণপণ চেষ্টা করছেন বাঁশটাকে ঠিক দাঁড় করাতে। কিন্তু গর্ত বেশি গভীর নয়। তাই বাঁশ হেলে যাচ্ছে। কাজের লোকজনেরা হেসে হেসে বলছেন, ‘‘ও কাকা, জোরসে ধরো না!’’
উপেনবাবুর বয়স ষাট পেরিয়েছে। উপেনবাবু স্বাস্থ্যসাথীর কার্ড পাননি। উপেনবাবুর বাড়িতে আলাদা শৌচাগার নেই। গায়ে লাগোয়া তাঁর ছেলের বাড়ি বরং অনেক গোছানো। সব আছে তাতে। কেন? ‘‘আমায় কোনও সরকার কিছু দেয়নি তো,’’ বাষ্পের মতো ক্ষোভ উঠল গলা দিয়ে। পাশ থেকে ঠিকাদারের লোকজনেরা বললেন, ‘‘দুয়ারে সরকারের ক্যাম্পে যায়নি তো।’’ বিড়বিড় করতে লাগলেন উপেন।
‘...পিরিতি এক অউদগা ভাবনা!’
জাতীয় সড়ক থেকে ডান দিকে যে পথ ঢুকেছে গ্রামের ভিতরে, তার শুরুতেই বাজার। সেখানে একটি গাছে একে একে বিঁধে রয়েছে তৃণমূল, বিজেপি, সিটু, কামতাপুর পিপলস পার্টির (কেপিপি) পতাকা। দেখিয়ে এক দোকানি মুচকি হেসে বললেন, ‘‘এ-ও এক পিরিতির আঠা।’’
এই বাজারেই রণজিৎ জয়সওয়ালের হাস্কিং মিল। বড় রাস্তা ছাড়িয়ে গলিপথে ঢুকতেই টিনের ঘরটি। সামনে কাঁচা পথে চেয়ার-টেবিল নিয়ে বসে আছেন রণজিৎবাবু। টেবিলে পা তুলে বসে বিশ্রাম নিচ্ছেন। মাথার পিছনে হাত দু’টি। চূড়াভাণ্ডারই শুধু নয়, এতদ এলাকায় ধানের ফলন ভাল। চায়ের দেশ হলেও চালের প্রতি দরদ কম নয়। ‘‘তবে এখন তেমন কাজ নেই। ধান উঠে গিয়েছে। খেতে এখন সর্ষে। তা উঠলে আবার ভিড় হবে,’’ জানান তিনি।
সত্যিই গাঁয়ের পাশে ছোট ছোট মাঠ হলুদে ছেয়ে আছে। তাতে লেগেছে ঝিরঝির হাওয়া। দূরে বাড়ির পাশে খাটাল। তার সামনে খোলা জমিতে গরু বেঁধে দুধ দুইছেন এক জন। রাস্তার অন্য পাড়ে আইসিডিএসের বাড়ি, গায়ে তার ছোটা ভীম, হাতি আঁকা। পাশের বাড়িটির দেওয়ালেও আলপনার বাহার। ও পাড়ায় বাঁশের কাঠামো উঠেছে বাড়ি ঘিরে। সেই কাঠামোয় জড়ানো লাল, হলুদ কাপড়।