চণ্ডীচরণ বাউরি নিজস্ব চিত্র।
‘গায়েন’ নজরে কেন? এক সময় খঞ্জনি হাতে গ্রামে-গ্রামে আসর জমানো কীর্তন দলের ‘গায়েন’ চণ্ডীচরণ বাউরির রানিগঞ্জের বাড়িতে সম্প্রতি সিবিআই অভিযানের পরে, এ প্রশ্নের জবাব খুঁজেছেন অনেকে—অবৈধ কয়লার কারবারি, জেলা রাজনীতির ওঠাপড়ার নিয়মিত পর্যবেক্ষক, এমনকি, পুলিশ কর্মীদের একাংশও। নানা অনুমান থাকলেও একটি ব্যাপারে সবাই এক মত—সিবিআইয়ের নজর এখন অবৈধ কয়লার কারবারের পিরামিডের আগাপাশতলায়।
সিবিআই সূত্রের দাবি, পশ্চিম বর্ধমানের (রাজ্যেরও) অবৈধ কয়লা কারবারের শীর্ষবিন্দু—অনুপ মাজি ওরফে ‘লালা’। তাঁর নীচে রয়েছেন জয়দেব মণ্ডল-সহ কয়েকজন ‘এজেন্ট’। ‘এজেন্ট’দের নীচের স্তরে গোটা জেলায় ছড়ানো সাত-আট হাজার কুয়ো-খাদের প্রায় শ’পাঁচেক মালিক এবং জনা ষোলো অবৈধ খোলা মুখ খনির কারবারি। দামালিয়া গ্রামের চণ্ডী সেই ষোলোর মধ্যে এক জন। পিরামিডের শেষ ধাপ— কাজের নিরিখে আলাদা শ্রমিকদের।
চণ্ডীচরণের অবৈধ খোলামুখ খনি রয়েছে দামালিয়ায়, দাবি অবৈধ কয়লা কারবারের এক সূত্রের। যখন পরিস্থিতি ‘অনুকূল’ ছিল, সেখান থেকে গড়ে প্রতিদিন ৫০০ টন কয়লা তোলা হত। সে কয়লা লালার ‘এজেন্ট’কে দিয়ে মিলত টাকা। তা দিয়েই মেটানো হত কয়লা কাটা থেকে পরিবহণ—নানা স্তরের অন্তত দু’শো জন কর্মীর মজুরি (৪০০ থেকে এক হাজার টাকা প্রতি দিন)। এ ছাড়া, টন প্রতি ৮০ টাকা দরে ‘খাদান মালিকের’ আয় হত দিনে প্রায় ৪০ হাজার টাকা। আবার কুয়ো-খাদ থেকে দৈনিক ৩০-৪৫ টন কয়লা উঠলেও, এক মালিকের দখলে তেমন অনেক কুয়ো-খাদ থাকায়, তাতেও রোজগার কম হয় না। রোজগারের নিরিখে এমন অনেকে রয়েছেন, এক বন্ধনীতে।
তা হলে চণ্ডীর খোঁজ কেন?
নব্বইয়ের দশকের গোড়ার দিকে প্রাক্তন ইসিএল কর্মীর বছর আঠারোর ছেলে চণ্ডীচরণ কীর্তনের দলে নাম লেখান। পরে ইট ভাটা, পাথর খাদান, স্টোনচিপস সরবরাহ, জমির দালালি, পরিবহণের ব্যবসা-সহ নানা পথ ঘুরে ২০০৭-এ অবৈধ কয়লার ব্যবসায় জড়ান বলে অভিযোগ। রানিগঞ্জ থানায় তাঁর বিরুদ্ধে রয়েছে অবৈধ কয়লা পাচারের মামলাও। তবে তাতে জামিনে মুক্ত। একদা বাম-ঘনিষ্ঠ চণ্ডীচরণ রাজ্যে পালাবদলের পরে, রাজনৈতিক আনুগত্য বদলান বলে দাবি। যদিও তৃণমূল বা সিপিএম সে কথা মানে না।
চণ্ডী সিবিআইয়ের নজরে আসার পরে, কয়লার অবৈধ কারবারে জড়িতদের এবং পুলিশের একাংশের ধারণা, তৃতীয় স্তরের কয়লা কারবারিদের সৌজন্যে লালা এবং ‘এজেন্ট’রা দৈনিক, মাসিক বা বাৎসরিক কত টাকার কারবার করে থাকতে পারেন তা অনুমানের চেষ্টা হচ্ছে। সেই সঙ্গে চণ্ডীর দৌলতে রাঘব বোয়ালদের হদিস মেলা সম্ভব কি না—দেখা হচ্ছে তা-ও।
‘ম্যান, মানি, মাফিয়া’—শব্দগুচ্ছ বহু দিনই শোনা যায় পশ্চিম বর্ধমানের কয়লাঞ্চলে। অনেকের কাছে যার মানে—মাফিয়া যার পক্ষে, তার দিকেই অর্থ এবং লোকবল। রাজনৈতিক পর্যবেক্ষকদের একাংশের অনুমান, চণ্ডীর স্তরের যে সব কারবারিরা রাজনৈতিক দলগুলিকে লোক, গাড়ি পাঠিয়ে, টাকা দিয়ে সাহায্য করেন বলে অভিযোগ, তাঁদেরও কেন্দ্রীয় এজেন্সি সিবিআইয়ের তৎপরতা দেখিয়ে বিধানসভা ভোটের আগে দূরে সরে থাকার বার্তা দেওয়া হচ্ছে।
কোনও রাজনৈতিক দলই মাফিয়া-সংশ্রবের কথা মানেনি। নাম প্রকাশ না করার শর্তে একাধিক রাজনৈতিক নেতার দাবি, ‘‘মাফিয়ার টাকা ব্যক্তির কাজে লেগে থাকতে পারে। তাতে দলের যোগ নেই। মাফিয়ার কথায় লোকে ভোট দেয় না।’’
সিবিআই অভিযানের পরে, এলাকায় চণ্ডীচরণকে দেখা যাচ্ছে না। কিন্তু দামালিয়ায় গেলে শোনা যাচ্ছে, প্রতিদিন প্রায় একশো জন আশ্রয়হীনকে দুপুরে খাওয়ানো, মন্দির নির্মাণ, ক্যানসার আক্রান্তের চিকিৎসায় পাশে দাঁড়ানোর মতো চণ্ডীর নানা ‘গল্প’। ফোনে অবৈধ কয়লার কারবারে জড়িত থাকার অভিযোগ উড়িয়ে চণ্ডী বলেছেন, ‘‘পরিবহণের ব্যবসা করি। নামগান গাই। সিবিআই আমাকে কেন খুঁজছে, কে জানে?’’