—প্রতীকী ছবি।
সিধু জ্যাঠা: কী ব্যাপার ফেলু? আবার ভবানন্দের মতো কোনও ভণ্ড স্বামীজি আর তার অপোগণ্ড চ্যালা সম্পর্কে জানতে এসেছ?
ফেলুদা: না। এ বার এসেছি পূর্ব কলকাতা জলাভূমিতে একটি ট্রাস্টের বেআইনি নির্মাণ সম্পর্কে জানতে। ওই ট্রাস্টের সঙ্গে নাকি জাতীয় স্তরে ‘প্রভাবশালী’ এক ব্যক্তির নাম জড়িয়ে রয়েছে।
সিধু জ্যাঠা: দাঁড়াও (একটা ফাইল বার করে)। এই যে, ২০১৭ সালের অক্টোবরে জাতীয় পরিবেশ আদালতের বেঞ্চ তিন মাসের মধ্যে ওই নির্মাণ ভেঙে ফেলতে বলেছিল।
ফেলুদা: কিন্তু সাড়ে ৩ বছর পরেও তো কিছু হল না!
সিধু জ্যাঠা: যেখানে জাতীয় পরিবেশ আদালতের নিষেধাজ্ঞা সত্ত্বেও রবীন্দ্র সরোবরে ছটপুজোর অনুমতি পেতে রাজ্য সরকার সুপ্রিম কোর্টে যায়, যেখানে বায়ুদূষণ রোধে ব্যর্থ হওয়ায় রাজ্যের পাঁচ কোটি টাকা জরিমানা হয়, সেখানে এর থেকে বেশি কী প্রত্যাশা করো?
ফেলুদা: অথচ পরিবেশ খাতে বরাদ্দ তো বেড়েছে। বর্তমান সরকারের প্রথম বাজেটে ৩০.৪৭ কোটি টাকা থেকে বেড়ে এই খাতে সাম্প্রতিকতম বাজেটে ৯৭.৪৬ কোটি টাকা হয়েছে!
সিধু জ্যাঠা: বরাদ্দ বাড়ালেই বুঝি পরিবেশ রক্ষা হয়? তা হলে শোন, বর্তমান সরকার দু’টি বিধানসভা নির্বাচন (২০১১ ও ২০১৬), দু’টি লোকসভা নির্বাচন (২০১৪ ও ২০১৯) লড়েছে। অন্য নির্বাচনগুলির কথা বাদই দিচ্ছি। কিন্তু ক্ষমতাসীন সরকারের কোনও নির্বাচনী ইস্তাহারেই পরিবেশ নিয়ে বিশেষ কিছু বলা হয়নি। ২০১১ সালের ইস্তাহারে বলা হয়েছিল, —‘কৃষি’-‘শিল্প’-‘শিক্ষা’-‘স্বাস্থ্য’-‘সংস্কৃতি’ আর ‘সুশাসন’। আবার ২০১৫ সালের কলকাতা পুর নির্বাচনের ইস্তাহারে ‘উন্নয়নের অগ্রগতি, প্রগতি ও সৌন্দর্যায়ন’-কে গুরুত্ব দেওয়া হয়েছিল।
ফেলুদা: কিন্তু যত দূর মনে পড়ছে, ২০১১ সালের ইস্তাহারে একটা ইন্টারেস্টিং ক্যাচলাইন ছিল।—‘ফেলে দিয়ে ফিরিয়ে নেব’। অর্থাৎ, জঞ্জাল প্রক্রিয়াকরণের মাধ্যমে দূষণ রোধের পাশাপাশি মিথেন গ্যাস-সহ জৈব সার প্রস্তুতের কথা বলেছিল সরকার। খুব নিরপেক্ষ ভাবে বললে মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় তবু চেষ্টা করছেন। ‘সেভ গ্রিন স্টে ক্লিন’ কর্মসূচির পাশাপাশি রাজ্য যে আগের থেকে পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন হয়েছে, সেটা অস্বীকার করা যাবে না।
সিধু জ্যাঠা: অস্বীকার করছি না তো। পরিবেশকর্মী সুভাষ দত্ত, নব দত্তের মতো কিছু মানুষও তো চেষ্টা করছেন। পরিবেশমন্ত্রী সৌমেন মহাপাত্রও চেষ্টা করছেন বলে শুনছি। তবে অনিয়ম হচ্ছে দেখেও রাজ্য দূষণ নিয়ন্ত্রণ পর্ষদের শীর্ষ কর্তারা একাধিক ক্ষেত্রে ব্যবস্থা না নেওয়ায় সেগুলি বিক্ষিপ্ত প্রচেষ্টা হিসেবেই থেকে যাচ্ছে। আর বর্জ্য প্রক্রিয়াকরণের কথা বলছ?—দৈনিক উৎপন্ন হওয়া বর্জ্যের মাত্র ৫-৭ শতাংশের প্রক্রিয়াকরণ হয়। এর সঙ্গে রয়েছে বেনিয়ম।
ফেলুদা: ঠিকই। তাই বছর তিনেক আগে রাজ্যে শিল্পজনিত দূষণের ‘পারফর্ম্যান্স অডিট’-এর সময়ে ‘কন্ট্রোলার অ্যান্ড অডিটর জেনারেল অব ইন্ডিয়া’(সিএজি) জানিয়েছিল, ২০১৭ সালে রাজ্যে ৫,৪৫২টি ‘রেড ক্যাটেগরিভুক্ত’ শিল্পের মধ্যে মাত্র ১,৯০৮টির বৈধ ছাড়পত্র রয়েছে। ২,৭৯৭টি শিল্প বৈধ ছাড়পত্র ছাড়াই ব্যবসা চালাচ্ছিল! ২০২০ সালে অবশ্য এই পরিস্থিতির খানিকটা উন্নতি হয়েছে। আবার দূষণ ছড়ায়, গঙ্গার পাড়স্থিত এমন ৩৭৬টি ইউনিটের ক্ষেত্রে নিয়মিত নজরদারি হয় না। ৫৪টি নালার মাধ্যমে শিল্পজনিত তরল বর্জ্য গঙ্গায় মিশলেও রাজ্য দূষণ নিয়ন্ত্রণ পর্ষদ সেগুলিতে ‘কমন অ্যাফ্লুয়েন্ট ট্রিটমেন্ট প্লান্ট’ তৈরির প্রক্রিয়া শুরু করেনি। তার উপরে ৬৪টি প্রকল্পের মধ্যে ২৪টি প্রকল্পেই বিধি ভেঙে পরিবেশের ছাড়পত্র দেওয়া হয়েছিল।
সিধু জ্যাঠা: জিতে রহো বচ্চে! সিএজি কিন্তু এটাও বলেছিল, দূষণ রোধের প্রাথমিক ধাপ হিসেবে ‘জোনিং অ্যাটলাস’, অর্থাৎ, শিল্প স্থাপন হলে সংশ্লিষ্ট এলাকায় পরিবেশগত কী প্রভাব পড়বে, তা তৈরি করা জরুরি। সেটা পর্যন্ত পর্ষদ করে উঠতে পারেনি! এমনকি, কেন্দ্রীয় দূষণ নিয়ন্ত্রণ পর্ষদ একাধিক বার (২০১২ ও ২০১৬ সালে) বলা সত্ত্বেও বায়ুদূষণ রোধে ‘অ্যাকশন প্ল্যান’ তৈরি না করায় রিপোর্ট বলেছিল,—‘বায়ুদূষণ নিয়ন্ত্রণে রাজ্য সরকারের প্রচেষ্টা ও উদ্যোগের অভাব রয়েছে।’ যদিও সেই অ্যাকশন প্ল্যান এখন তৈরি হয়েছে।
ফেলুদা: একই ভাবে দূষণ-বিধি লঙ্ঘনের জন্য ৯৫টি ইউনিট বন্ধ করলেও মাত্রাতিরিক্ত দূষণ ছড়ায় এমন ৫১৪টি শিল্পের মধ্যে মাত্র ৪৩টি ইউনিটে নিয়মিত নজরদারি হয়। বাকি ৩৭৬টির ক্ষেত্রে নিয়মিত নজরদারির কোনও ব্যবস্থাই নেই।
সিধু জ্যাঠা: তা হলে এ-ও জেনে রাখো, জাতীয় পরিবেশ আদালতের নির্দেশমতো পাঁচ মাস আগেই কেন্দ্রীয় দূষণ নিয়ন্ত্রণ পর্ষদ সারা দেশের দূষণ নিয়ন্ত্রণ পর্ষদগুলির একটি ‘পারফর্ম্যান্স অডিট’ প্রকাশ করেছে। সেখানে দেখা যাচ্ছে, সারা দেশে পরিবেশবিধি লঙ্ঘন করা ২৩৬টি তরল বর্জ্য পরিশোধন প্লান্টের ৪২টি-ই হল এ রাজ্যের। আবার নীতি আয়োগ নির্ধারিত ‘সাসটেনেবল ডেভেলপমেন্ট গোলস ইনডেক্স’ (এসডিজি ইনডেক্স) অনুযায়ী দেশের মধ্যে পশ্চিমবঙ্গ রয়েছে ১৪তম স্থানে। তবে গবেষণা, উন্নয়ন ও প্রশিক্ষণের ক্ষেত্রে দেশের মধ্যে দ্বিতীয় হল পশ্চিমবঙ্গ। এটা গৌরবের বিষয়। তা ছাড়া নদী-জলাশয়ের পাড়স্থিত ১৭টি ‘ক্যাটেগরিভুক্ত’ শিল্পের মধ্যে ৭৫ শতাংশই পরিবেশবিধি মেনে চলে। পরিবেশবিধি ভেঙেছে এমন ২৪টি শিল্পের মধ্যে ১৫টিকে শো-কজ এবং ৯টি শিল্প বন্ধের নির্দেশ দিয়েছে রাজ্য দূষণ নিয়ন্ত্রণ পর্ষদ। যদিও ‘ডেটা ম্যানেজমেন্ট অ্যান্ড পাবলিক আউটরিচ’-এ পিছিয়ে রয়েছে রাজ্য।
ফেলুদা: তরল নিকাশি বর্জ্য পরিশোধনের ক্ষেত্রেও তো রাজ্য পিছিয়ে রয়েছে। তরল বর্জ্যের ৯৬ শতাংশই পরিশোধিত হয় না। আবার নিকাশি পরিশোধন প্লান্টের মাত্র ৫ শতাংশ পরিবেশ-বিধি মেনে চলে।
সিধু জ্যাঠা: তা হলে বোঝ অবস্থাটা! বিশ্বের অনেক দেশ ‘ক্লাইমেট এমার্জেন্সি’ ঘোষণা করলেও এখানে কেন হয় না ফেলু? আমরা কি বিপদ জেনেও চোখ বুজে রয়েছি? তুমি কি জান, অক্সফোর্ড অভিধান ‘ক্লাইমেট এমার্জেন্সি’ শব্দটিকে ২০১৯ সালে ‘ওয়ার্ড অব দ্য ইয়ার’ হিসেবে ঘোষণা করেছিল?
ফেলুদা (স্মিত হেসে): না, জানতাম না। তবে এ টুকু জানি, আপনি গোয়েন্দাগিরি করলে আমাদের আর পসার থাকত না।
সিধু জ্যাঠা: আমি অনেক কিছু করলে অনেকেরই পসার থাকত না। তাই আমি কিছুই করিনি। শুধু মনের জানলাগুলো খুলে দিয়ে বসে আছি। যাতে আলো আর বাতাস ঢুকে মনটাকে তাজা রাখে। তবে দূষিত বায়ু ঢোকার ভয়ে ঘরের জানলাগুলো এখন আর বিশেষ খুলি না!