শেষ কথা বলবেন মমতাই। ফাইল চিত্র
দুর্নীতির অভিযোগ রয়েছে এমন নেতাদের মন্ত্রিসভা থেকে বাদ দেওয়ার দাবি অনেক আগেই উঠেছিল তৃণমূলে। এখন শিল্পমন্ত্রী পার্থ চট্টোপাধ্যায়কে এনফোর্সমেন্ট ডিরেক্টরেট (ইডি) গ্রেফতার করার পরে সেই পুরনো দাবি নতুন করে উঠতে শুরু করেছে। দলের একাংশের বক্তব্য, সমস্ত মন্ত্রী ইস্তফা দিন। তার পর মন্ত্রিসভা ঢেলে সাজান মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়।
মন্ত্রিসভা ঢেলে সাজার যে দাবি, তা মূলত তুলতে শুরু করেছেন দলের অন্দরে অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়ের অনুগামী হিসাবে পরিচিতরা। দলীয় সূত্রের খবর, তৃণমূলের অন্দরে এঁরা একটি ‘প্রেসার গ্রুপ’ তৈরির চেষ্টা করছেন। যাতে ‘কলুষহীন’ এবং ‘স্বচ্ছ ভাবমূর্তি’র মন্ত্রিসভা গঠন করা যায়।
প্রসঙ্গত, অতীতে বেশ কয়েকজনকে মন্ত্রী না-করার দাবি তুলেছিলেন অভিষেক। তাঁর আপত্তি ছিল মূলত সেই নেতাদের মন্ত্রী করা নিয়ে, যাঁরা বিভিন্ন সময়ে দুর্নীতিতে জড়িয়ে পড়েছেন। অসমর্থিত সূত্রের খবর, দল সেই বক্তব্য না-মানায় ২০১৬ সালে সরকারের শপথগ্রহণে অংশ নেননি অভিষেক। তবে প্রকাশ্যে কখনওই এ নিয়ে কিছু বলেননি তিনি। তৃণমূলের তরফেও কোনও আনুষ্ঠানিক প্রতিক্রিয়া জানানো হয়নি। তার পরে আরও পাঁচ বছর পেরিয়ে গিয়েছে। তখন অভিষেক ছিলেন সাংসদ এবং যুব তৃণমূল সভাপতি। এখন তিনি দলের সর্বভারতীয় সাধারণ সম্পাদক। সংগঠনের রাশও অনেকটাই তাঁর হাতে। এমতাবস্থায় পার্থের গ্রেফতারির প্রেক্ষিতে অভিষেকের সেই মনোভাব নিয়ে দলের অন্দরে আবার আলাপ-আলোচনা শুরু হয়েছে।
প্রসঙ্গত, পার্থকে শুক্রবার ইডি জেরা শুরু করার পরেও দলের পক্ষে শিল্পমন্ত্রীর ‘পাশে’ থাকার বার্তাই দিয়েছিল তৃণমূল। প্রথমে ফিরহাদ (ববি) হাকিম এবং পরে চন্দ্রিমা ভট্টাচার্য— দুই মন্ত্রীই ‘প্রতিহিংসার রাজনীতি’র কথা বলেছিলেন। কিন্তু পরে ইডি যখন প্রকাশ্যে জানায়, ‘পার্থর ঘনিষ্ঠ’ অর্পিতা মুখোপাধ্যায়ের ফ্ল্যাট থেকে বিপুল পরিমাণে নগদ টাকা, মোবাইল ফোন এবং অলঙ্কার উদ্ধার হয়েছে, তখন থেকেই ছবিটা পাল্টে যায়। পার্থের সঙ্গে ‘দূরত্ব’ তৈরি করতে শুরু করে তৃণমূল। উদ্ধার-হওয়া টাকার সঙ্গে দলের কোনও সম্পর্ক নেই বলে টুইট করেন মুখপাত্র কুণাল ঘোষ।
শনিবার সকালে পার্থকে গ্রেফতারের পর তৃণমূলের পক্ষে দুপুর পর্যন্ত নির্দিষ্ট কিছু জানানো হয়নি। কিন্তু পার্থের মন্ত্রিত্ব এবং দলের মহাসচিব পদ থাকবে কি না, তা নিয়ে প্রশ্ন উঠতে শুরু করেছে তৃণমূলের ভিতরে-বাইরে। সেই সঙ্গেই উঠছে ২০১৬ সালের প্রসঙ্গও।
শনিবার তৃণমূলের এক বিধায়ক বলেন, ‘‘অভিষেক অনেক আগেই কিছু নির্দিষ্ট কারণ দেখিয়ে দলের কয়েকজনকে মন্ত্রিসভা থেকে বাদ দেওয়ার কথা বলেছিলেন। পাশাপাশিই বলেছিলেন, ওই নেতাদের যাতে দলের গুরুত্বপূর্ণ পদে না রাখা হয়। কিন্তু সেটা করা হয়নি। এখন সম্ভবত তারই ফল বোঝা যাচ্ছে।’’
শিক্ষাক্ষেত্রে দুর্নীতির অভিযোগ অনেক দিন ধরেই সামলাতে হচ্ছে তৃণমূলকে। জবাবে বিরোধীদের পাল্টা আক্রমণের পথে হেঁটেছে শাসকশিবির। ওই দুর্নীতির বিষয়ে আদালত সিবিআই তদন্তের নির্দেশ দেওয়ার পরেও দল নির্দিষ্ট অভিযোগে সওয়াল করতে পেরেছিল। কিন্তু নগদ ২১ কোটিরও বেশি টাকা উদ্ধারের মতো ঘটনা দলের মুখ বন্ধ করে দিয়েছে বলেও মনে করছেন পার্থ-কাণ্ডে ক্ষুব্ধ নেতারা। তাঁদেরই একজন শনিবার বলেন, ‘‘বাংলায় এই ভাবে এত টাকা উদ্ধারের ছবি অতীতে দেখা যায়নি। এর প্রভাব দলের উপর পড়বে না বললে সত্যকে অস্বীকার করা হবে। দলের ভাবমূর্তিতেও অবশ্যই ধাক্কা লেগেছে। এটা সারদা বা নারদ-কাণ্ডের থেকেও অনেক বড় ধাক্কা।’’
সেই সূত্রেই ওই অংশের তৃণমূল নেতারা চাইছেন, মন্ত্রিসভা ঢেলে সাজা উচিত দলনেত্রীর। পার্থের হাতে শিল্প ছাড়াও রয়েছে দু’টি গুরুত্বপূর্ণ দফতর। পরিষদীয়, তথ্যপ্রযুক্তি এবং ইলেকট্রনিক্স দফতর। পার্থ গ্রেফতার হওয়ার পরে তাঁকে মন্ত্রিসভা থেকে বাদ দেওয়া হলে নতুনদের দায়িত্ব দিতে হবে। সেই সময়েই গোটা মন্ত্রিসভা ঢেলে সাজা হোক বলে মনে করছেন এই নেতারা।
তৃণমূলের বেশ কয়েকজন নেতাকে নিয়ে প্রশ্ন তুলেছিলেন অভিষেক। কিন্তু মুখ্যমন্ত্রী মমতা তাঁর ‘অসময়ের সঙ্গী’-দের বাদ দিতে চাননি। দলের নেতারা তেমনই বলেন। তাঁদের মমতা ভরসাও করেন। ওই নেতারা মমতার উপরে নানাভাবে ‘প্রভাব’ খাটানোরও চেষ্টা করেন। দলকে কুক্ষিগত করে রাখতে চান বলে তরুণ প্রজন্মের বক্তব্য। পার্থের গ্রেফতারির পর সেই বক্তব্য আরও উচ্চগ্রামে যাচ্ছে। এখন দেখার, মমতা দলের অন্দরে এই বক্তব্যকে কতটা আমল দেন। তৃণমূলের একাংশের বক্তব্য, মমতা প্রবীণ এবং নবীন প্রজন্মের মেলবন্ধন ঘটিয়ে মন্ত্রিসভায় রদবদল করলে তা দলের পক্ষে ভাল হবে। কারণ, এই সরকারের সময়কাল এক বছরের সামান্য বেশি হয়েছে। এখনও অনেকটাই পথচলা বাকি।