(বাঁ দিকে) শুভেন্দু অধিকারী এবং সৌমেন মহাপাত্র। —ফাইল চিত্র।
ক্ষোভ যে বাড়ছে, তা নিয়ে অনেক দিন ধরেই আলোচনা চলছিল দলের অন্দরে। এ বার তা প্রকাশ্যে বেরিয়ে এল। পদ নেই বলে এখন তাঁর ডাকে কেউ সাড়া দেন না বলে অভিযোগ তুলে ক্ষোভ উগরে দিলেন রাজ্যের প্রাক্তন মন্ত্রী সৌমেন মহাপাত্র। কার্যত হুঁশিয়ারির সুরে তমলুকের তৃণমূল বিধায়কের এ-ও মন্তব্য, ‘তৃতীয় শক্তি’ মাথাচাড়া দিলে তা মাথাব্যথার কারণ হয়ে উঠবে! তাঁর কথায়, ‘‘সহ্যের সীমা অতিক্রম করলে তা বিপজ্জনক হয়ে উঠতে পারে।’’
হঠাৎ এই আক্রমণের তির কাকে লক্ষ্য করে, তা অবশ্য স্পষ্ট করেননি সৌমেন। তবে তাঁর মন্তব্য নিয়ে স্বাভাবিক ভাবেই জল্পনা তৈরি হয়েছে। জেলার নেতাদের একান্ত আলাপচারিতাতেও আলোচ্য হয়ে উঠেছে বিষয়টি। দলের একাংশের মত, গত বিধানসভা নির্বাচনের পর থেকেই জেলায় ‘কোণঠাসা’ করা হয়েছে সৌমেনকে। পদ কেড়ে নেওয়া হয়েছে। ফলে এটা কার্যত স্পষ্ট যে, প্রাক্তন মন্ত্রীর নিশানায় দলের শীর্ষ নেতৃত্বই। তৃতীয় শক্তির কথা বলে সৌমেন নতুন দল তৈরির ইঙ্গিত দিলেন কি না, তা নিয়েও প্রশ্ন তুলছেন অনেকে। এ প্রসঙ্গে তৃণমূল মুখপাত্র তথা দলের রাজ্যসভা সাংসদ শান্তনু সেন বলেন, ‘‘কেউ যদি দলের অনুগত হন, তা হলে দলীয় অনুশাসন মেনে তাঁর যা বলার, দলের মধ্যেই বলা উচিত। আর মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের বিরুদ্ধে কোনও শক্তিই মাথাচাড়া দিতে পারবে না, কারণ সারা বাংলার আপামর জনগণ তাঁর পাশেই রয়েছেন।’’
দলীয় সূত্রে খবর, গত মঙ্গলবার পাঁশকুড়া পুরসভার ১০ নম্বর ওয়ার্ড কমিটি আয়োজিত পাঁশকুড়া গ্রামীণ মেলার উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে গিয়েছিলেন সৌমেন। ওই মেলার পৃষ্ঠপোষক সৌমেনের স্ত্রী তথা ১০ নম্বর ওয়ার্ডের তৃণমূল কাউন্সিলার সুমনা মহাপাত্র। সেই মেলার উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে আমন্ত্রিত ছিলেন জেলাশাসক, পুলিশ সুপার, তমলুকের মহকুমাশাসক, পাঁশকুড়া পুরসভার চেয়ারম্যান-সহ জেলা তৃণমূলের প্রথম সারির বহু নেতা। অভিযোগ, ওই অনুষ্ঠানে প্রশাসনিক কর্তারা তো বটেই, দলীয় নেতৃত্বেরও কেউ যাননি। তা নিয়েই প্রকাশ্যে ক্ষোভ প্রকাশ করেন সৌমেন। তিনি বলেন, ‘‘পদের বড় মোহ। আমি যদি পদে থাকতাম, তা হলে জেলার ডিএম, এসপি থেকে শুরু করে আপনাদের এখানকার (পাঁশকুড়া পুরসভার) চেয়ারম্যান এই মঞ্চ আলোকিত করতেন।’’ এর পরেই সৌমেনের বার্তা, ‘‘আসলে দেখুন, বিন্দু দিয়ে সিন্ধু হয়। আমরা যদি বিন্দু হই, তবে সিন্ধু রক্ষা পাবে। আর বিন্দু যদি না থাকে, তবে সিন্ধু রক্ষা পাবে না!’’
সম্প্রতি বিরোধী দলনেতা শুভেন্দু অধিকারীর পিতা তথা সাংসদ (খাতায়কমলে অবশ্য তৃণমূলেরই) শিশির অধিকারীর পা ছুঁয়ে, তাঁকে গুরুদেব সম্বোধন করে জেলায় শোরগোল ফেলে দিয়েছিলেন তৃণমূল নেতা তথা কাঁথির সদ্যপ্রাক্তন পুরপ্রধান সুবল মান্না। সেই সময়েই শোনা গিয়েছিল, জেলায় শাসকদলের ছোট-বড় অনেক নেতাই নাকি অধিকারীদের সঙ্গে যোগাযোগ রেখে চলছেন! দলীয় সূত্রে দাবি, তৃণমূলের যে সব নেতার নাম নিয়ে ওই সময় জল্পনা তৈরি হয়েছিল, তাঁদের মধ্যে সৌমেন অন্যতম ছিলেন। ২০২১ সালের বিধানসভা ভোটের সময়েও শুভেন্দু বনাম সৌমেনের টক্কর ছিল জেলা রাজনীতির অন্যতম আলোচ্য বিষয়। পাল্টা কর্মসূচি তো ছিলই, পরস্পরকে বাক্যবাণে বিদ্ধ করতেন তাঁরা। তাৎপর্যপূর্ণ ভাবে প্রথমে মন্ত্রিত্ব, তার পরে জেলা সভাপতির পদ যাওয়ার পরে সেই সৌমেনের গত কয়েক মাস ধরে শুভেন্দুকে নিয়ে ‘নীরব’ দলীয় নেতা-কর্মীদের নজর কেড়েছিল। শুধু তা-ই নয়, শুভেন্দু ও সৌমেনের মধ্যে সাক্ষাৎ হয়েছে, এমন একটি দাবি নিয়ে আলোচনাও হয়েছিল দলের অন্দরে।
যদিও সেই সময় এ সব দাবি নস্যাৎ করে দিয়েছিলেন সৌমেন নিজেই। শুভেন্দুর সঙ্গে সাক্ষাতের দাবি ‘ভিত্তিহীন’ জানিয়ে তাঁর পাল্টা অভিযোগ ছিল, ‘‘যারা আমার বিরুদ্ধে এ ধরনের প্রচার করছে, তারাই রাতের অন্ধকারে শুভেন্দুর সঙ্গে যোগাযোগ রেখে চলে।’’ পাশাপাশি তাঁর বক্তব্য ছিল, ‘‘শুভেন্দু এখন প্রধান বিরোধী দল বিজেপিতে। তাই, শুভেন্দুও আমার বিরোধী। কিন্তু এ কি শুধু ব্যক্তি শুভেন্দুর বিরুদ্ধে লড়াই যে, আমাকে গালাগাল করতে হবে?’’
এ বার দলকে নিশানা করে জেলার রাজনীতিতে আবার আলোচনায় উঠে এলেন সেই সৌমেন। প্রচ্ছন্ন হুঁশিয়ারি দিয়ে তিনি বললেন, ‘‘এক একটা শক্তি ক্ষয় হলে, একটা তৃতীয় শক্তি সেখানে মাথাচাড়া দেয়। এটাও সবার মনে রাখা দরকার। আর তৃতীয় শক্তি যদি মাথাচাড়া দেয়, তা হলে অবিভক্ত মেদিনীপুর, যেখানে ত্রিপুরার থেকে বেশি মানুষ বসবাস করেন, সেখানে কিছু ঘটলে তৈরি থাকতে হবে।’’
দলের একাংশের মত, শুভেন্দু বিজেপিতে যাওয়ার পরই পূর্ব মেদিনীপুরে তৃণমূলের অন্যতম মুখ হয়ে উঠেছিলেন সৌমেন। জেলা তৃণমূল সভাপতির পদ থেকে শিশিরকে সরিয়ে আনা হয়েছিল তাঁকেই। তবে তার পর জল অনেক গড়িয়েছে। ইতিমধ্যে অন্য অনেক পুরনো আমলের নেতার মতোই তৃণমূলে সৌমেনের গুরুত্ব কমেছে। মন্ত্রিত্ব, জেলা সভাপতির পদ গিয়েছে। এ সব নিয়ে প্রাক্তন মন্ত্রী যে ক্ষুব্ধ, তা তাঁর মন্তব্যেই পরিষ্কার। বিষয়টি নিয়ে জেলায় জলঘোলা হতেই নিজের মন্তব্যের ব্যাখ্যাও দিয়েছেন সৌমেন। তিনি বলেন, ‘‘পদ নিয়ে আর কী বলব! আমার পদ হারানোর মতো কিছু নেই। আমি দলের সৈনিক। তারা যেটা ভাল বুঝেছে, করেছে। দলের সিদ্ধান্ত নিয়ে আমার কিছু বলার নেই।’’