১০০ দিনের কাজে ‘বঞ্চিত’ একজনের সঙ্গে মঞ্চে কথা বলছেন অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়। ছবি: তৃণমূলের ফেসবুক পেজ থেকে।
রাজভবনের অদূরে কত দিন ধর্না-অবস্থান চালাবেন অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়? তৃণমূলের ‘সেনাপতি’ শুক্রবার, ধর্নার দ্বিতীয় দিনে নিজেই জানিয়ে দিয়েছেন, রাজ্যপাল সিভি আনন্দ বোস যদি পুজোর পরেও কলকাতায় ফেরেন, তা হলে তিনি সেই পর্যন্ত ধর্নায় বসে থাকবেন! পুজোর দিনগুলিতেও। শুক্রবারের ধর্না মঞ্চের পরিপার্শ্ব দেখে স্পষ্ট, তৃণমূলও ধরে নিচ্ছে টানা ধর্না চালাতে হতে পারে। এবং সেটা টানা-ই।
দিল্লি থেকেই বৃহস্পতিবারের ‘রাজভবন চলো’র ডাক দিয়েছিলেন অভিষেক। কিন্তু রাজ্যপাল তার আগেই কলকাতায় থেকে কেরল চলে যান। সেখান থেকে তিনি যান দিল্লি। দিল্লি থেকে বৃহস্পতিবার উত্তরবঙ্গের বন্যা পরিস্থিতি দেখে আবার দিল্লিতেই ফিরে যান বোস। আর মিছিলের শেষে অভিষেক আচমকাই ঘোষণা করে দেন, তিনি ধর্নায় বসলেন। যা তৃণমূলের পূর্বঘোষিত কর্মসূচির মধ্যে ছিল না। ফলে তড়িঘড়ি মঞ্চের পাশে অভিষেকের রাত্রিবাসের জন্য তাঁবু বানানো হলেও মূল মঞ্চের সামনে কোনও পোক্ত ছাউনি ছিল না। বৃহস্পতিবার সন্ধ্যায় যে সমস্ত কর্মী-সমর্থকেরা মঞ্চের সামনে বসেছিলেন, তাঁদের আচমকা বৃষ্টিতে ভিজতে হয়েছিল। শুক্রবার দেখা গেল সেই ছাউনির বন্দোবস্ত হয়েছে। ইস্পাত এবং বাঁশের কাঠামোর উপর খান তিনেক আস্তরণের ত্রিফল ফেলা হয়েছে। মঞ্চে রাতে যে নেতৃত্ব থাকবেন, তাঁদের জন্য মঞ্চ পর্দা দিয়ে ঘেরার ব্যবস্থাও করা হয়েছে।
মঞ্চের মাথায় পোক্ত ছাউনি। —নিজস্ব চিত্র।
বৃহস্পতিবার গাড়ির ভিড়ে রাজভবনের সামনের রাস্তায় যান লাচল বন্ধ হয়ে গিয়েছিল। শুক্রবার তা খুলে রাখা হয়েছিল। ফলে খানিক ধীরগতিতে হলেও রাজভবনের উত্তর গেটের সামনের রাস্তা দিয়ে যান চলাচল থমকে যায়নি।
শুক্রবার সকাল থেকেই জমায়েত আসতে শুরু করেছিল ধর্নাস্থলের দিকে। এক দিকে গ্রেট ইস্টার্ন হোটেলের মুখ, অন্য দিকে টেলিফোন ভবন পর্যন্ত ছড়িয়েছিল ভিড়। কিন্তু বৃহস্পতিবারের থেকে শুক্রবারের ছবি কিছুটা আলাদা। কারণ, তিনটি গুরুত্বপূর্ণ জায়গায় বসানো হয়েছে জায়ান্ট স্ক্রিন। যাতে সরাসরি সম্প্রচার চলছে মঞ্চের কর্মসূচির। বক্তৃতার। গানের।
ধর্নামঞ্চের তল্লাটে লাগানো হয়েছে জায়ান্ট স্ক্রিন। —নিজস্ব চিত্র।
শুক্রবার অবস্থান-বিক্ষোভস্থলে বেড়ে গিয়েছে হকারের সংখ্যাও। বৃহস্পতিবার যাঁরা জানতেন না, তাঁরাও এক দিনে জেনে গিয়েছেন। যেমন ধর্মতলা থেকে ধর্নাতলায় সেঁকা পাঁপড় বিক্রি করতে চলে এসেছেন সিকন্দর সাউ। বললেন, ‘‘এখানে তো রেডিমেড ভিড়। তাই এসেছি। ভাল বিক্রিও হয়েছে।’’ তৃণমূলের এক কর্মীর কাছেই সিকন্দর জানতে চাইলেন, ধর্না কত দিন চলবে? কর্মী রাজভবনের দিকে আঙুল দেখিয়ে জবাব দিলেন, ‘‘লাটসাহেব যবে ফিরবেন!’’ মুখ দেখে মনে হল, সিকন্দর চাইছেন না রাজ্যপাল খুব তাড়াতাড়ি বাড়ি ফিরুন!
রাজ্যপাল তৃণমূলকে দার্জিলিঙে দেখা করার সময় দিয়েছেন। অভিষেক জানিয়েছেন, দলের তরফে পঞ্চায়েত মন্ত্রী প্রদীপ মজুমদার, সাংসদ কল্যাণ বন্দ্যোপাধ্যায় ও মহুয়া মৈত্র শনিবার রাজ্যপালের সময়সূচি মেনে সেখানে যাবেন। কিন্তু রাজ্যপালকে কলকাতায় ফিরেই ‘মূল প্রতিনিধিদলে’র সঙ্গে দেখা করতে হবে। অর্থাৎ, রাজ্যপাল দার্জিলিঙে দেখা করলেও ধর্না উঠছে না। ধর্না যে লাগাতার চলবে, তার সাংগঠনিক প্রস্তুতিও সেরে ফেলেছে তৃণমূল। দিন ধরে জেলাভিত্তিক দায়িত্বও বণ্টন করে দেওয়া হয়েছে।
শুক্রবারও ধর্না-অবস্থানের মঞ্চে অভিষেককে ঘিরে ছিলেন নেতারা। বৃহস্পতিবার যাঁদের দেখা যায়নি, তাঁদের দেখা গেল শুক্রবার। অনেক উত্তরবঙ্গের বিধায়কেরও দেখা মিলল মঞ্চে। বৃহস্পতিবার নিজের লোকসভা কেন্দ্র আরামবাগের খানাকুলে গিয়ে বিক্ষোভের মুখে পড়েছিলেন সাংসদ অপরূপা পোদ্দার। শুক্রবার তাঁকে দেখা গেল ধর্না মঞ্চে। শুক্রবারও বক্তাদের গলায় শোনা গেল অভিষেকের চোয়ালচাপা লড়াইয়ের স্তূতি। তৃণমূলের অন্যতম মুখপাত্র তথা তালড্যাংরার প্রাক্তন বিধায়ক সমীর চক্রবর্তী যেমন বলেন, ‘‘নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসু যখন জাতীয় কংগ্রেসের সভাপতি হয়েছিলেন, তখন তাঁর বয়স ছিল ৪১ বছর। তাঁর নেতৃত্ব মেনে নিতে হয়েছিল ৬৯ বছর বয়সি মহাত্মা গান্ধীকে। রাজনীতিতে বয়সটা মাপকাঠি নয়। মানুষ যাঁকে নেতা মানবেন, তিনিই নেতা। এই মুহূর্তে ভারতে এক জনও অভিষেকের বয়সি নেতা নেই, যাঁর এইরকম জনমোহিনী ক্ষমতা রয়েছে। আমার এক এবং একমাত্র নেতার নাম আভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়।’’ দলের রাজ্য সম্পাদক কুণাল ঘোষ বলেন, ‘‘অভিষেক বাঘের বাচ্চার মতো সাহস দেখিয়ে আন্দোলন করছেন রাজভবনের সামনে। আর রাজ্যপাল পালিয়ে পালিয়ে বেড়াচ্ছেন।’’ রাত্রিবেলা রাজ্যপালের রোদচশমা পরা নিয়েও কটাক্ষ করেন কুণাল। কলকাতা পুরসভার কাউন্সিলর অরূপ চক্রবর্তীর কথায়, ‘‘এক দিকে লোডশেডিং করিয়ে জেতা বিধায়ক কেন্দ্রীয় মন্ত্রীর কাছে গিয়ে বলছেন বাংলার গরিব মানুষকে টাকা দেবেন না। উল্টোদিকে সেই সব মানুষকে সঙ্গে নিয়ে রাস্তায় বসে আছেন অভিষেক।’’
শুক্রবারেও বক্তৃতার মাঝে মঞ্চে চলেছে গান, কবিতা। শনিবার রাজ্যে আসার কথা কেন্দ্রীয় গ্রামোন্নয়ন প্রতিমন্ত্রী প্রজ্ঞা নিরঞ্জন জ্যোতির। যাঁর সঙ্গে দেখা করতে গিয়ে দেখা করতে পারেননি অভিষেকরা। তার পরে তাঁদের টেনেহিঁচড়ে তুলে নিয়ে গিয়েছিল দিল্লি পুলিশ। তিনি কলকাতায় এসে কী বলেন, তার পরে ধর্নামঞ্চ থেকে অভিষেকই বা তার কী জবাব দেন, সে দিকেই আপাতত তাকিয়ে বাংলা।