শুভাপ্রসন্ন বরাবরই তৃণমূলের ‘ঘনিষ্ঠ’ হিসাবে পরিচিত। ফাইল চিত্র।
বাংলা ভাষায় ‘পানি’ বা ‘দাওয়াত’-এর মতো শব্দের অনুপ্রবেশ নিয়ে তাঁর মন্তব্যের বিরোধিতা করেছেন স্বয়ং মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। তবে তাতে নিজের মত বদলাতে নারাজ শিল্পী শুভাপ্রসন্ন। বরং মমতা ‘রাজনীতির স্বার্থেই’ তাঁর বিরোধিতা করেছেন বলে আনন্দবাজার অনলাইনে দাবি করেছেন এই প্রবীণ শিল্পী। তাঁর কথায়, ‘‘আমি তো রাজনীতি করি না। আমি নির্বাচনেও লড়ব না। আমি ছবি আঁকি। তাই কোনও সম্প্রদায় বা শ্রেণিকে খুশি করার তাগিদ আমার নেই। আমি যেটাকে যথার্থ মনে করি, সেটাই বলেছি।’’ একই সঙ্গে শুভাপ্রসন্নের দাবি, বাংলা ভাষায় দিন দিন ‘সাম্প্রদায়িকতার ছায়া’ পড়ছে।
ঘটনার সূত্রপাত মঙ্গলবার দেশপ্রিয় পার্কে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা বিদস পালনের অনুষ্ঠানে। সেখানে মমতার উপস্থিতিতেই ভাষণ দিতে গিয়ে শুভাপ্রসন্ন বলেন, ‘‘বাংলা ভাষার উচ্চারণ, বাংলা ভাষার তাৎপর্য, বাংলার ভাষার বৈশিষ্ট্য থেকে আমরা সরে আসছি। আমরা দেখছি বহু কারণে, নানান সাম্প্রদায়িক ছাপ বাংলা ভাষায় চলে এসেছে।’’ এর পরেই তিনি সটান বলেন, ‘‘যে শব্দগুলোকে আমরা কখনও বাংলা বলি না, ভাবি না, সেই শব্দ এখন বাংলা ভাষায় ঢুকছে। আমরা কোনও দিন বাংলা ভাষায় পানি ব্যবহার করি না। আমরা কোনও দিন কখনও দাওয়াত দিই না। সুতরাং, ভাবতে হবে কোন ভাষা আমাদের ভাষা।’’
এর পরে বলতে উঠেই শুভাপ্রসন্নের বক্তব্যের বিরোধিতা করেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা। তিনি বলেন, ‘‘শুভা’দা অনেক শ্রদ্ধেয়। কিন্তু শুভা’দাকে একটা কথা বলব। দেখুন, কতগুলি শব্দ রয়েছে, যেগুলি সারা বিশ্বের। যেমন ‘মা’ বললে সবাই জানে দু’টি শব্দ রয়েছে। একটা ‘মা’ আর একটা ‘মাদার’। আর একটা শব্দ রয়েছে ‘জল’ বা ‘ওয়াটার’। কিন্তু ওয়াটারকে কেউ কেউ ‘পানি’ বলে। এটা আপনাকে মেনে নিতে হবে। মাকে কেউ ‘আম্মা’ বলে। এটাকে মেনে নিতে হবে। কেউ বারণ করেনি। আমি মা-ও বলব, আমি আম্মাও বলব।’’ মমতা আরও বলেন, ‘‘ওরা অতিথিসেবাকে দাওয়াত বলে। এটা বাংলাদেশের ভাষা। যাঁরা ও পার থেকে এ দেশে এসেছেন, তাঁরা এই ভাষাটাকে গ্রহণ করেছেন। আমি মাতৃভাষাকে চেঞ্জ (বদল) করতে পারি না। যেটা শিখে এসেছে, সেটা চেঞ্জ করবে কী ভাবে।’’
এর পরে ওই মঞ্চে শুভাপ্রসন্ন আর কিছু বলেননি। সেই সুযোগও ছিল না। বুধবার আনন্দবাজার অনলাইন তাঁর কাছে ওই বিষয়ে জানতে চাইলে শুভাপ্রসন্ন জানান, তিনি যা বলেছেন ভেবেচিন্তেই বলেছেন। বাংলা ভাষায় সাম্প্রদায়িকতা ঢুকছে বলে দাবি করে তিনি বলেন, ‘‘স্বামী বিবেকানন্দ বলেছিলেন, ঢাকা-শান্তিপুরের ভাষা মিশে কলকাতায় যে ভাষার প্রকাশ সেটাই আসল বাংলা ভাষার প্রকাশভঙ্গি। কিন্তু দিন দিন সেটা বদলে যাচ্ছে।’’ মুখ্যমন্ত্রীর আপত্তি প্রসঙ্গে বলেন, ‘‘মমতা তো বিষয়টা রাজনৈতিক ভাবে দেখবেন। ওঁর হয়তো মনে হয়েছে, এটা এই ভাবে বললে রাজনৈতিক অসুবিধা রয়েছে। কিন্তু আমার তো আর সেই ভয় নেই!’’
বরং শুভাপ্রসন্নের পাল্টা প্রশ্ন, ‘‘আমি যখন বাংলায় কথা বলি, তখন কি আপনাকে দাওয়াত দিই? আদাব,-আদাব বলি? আমি কি পানি বলি? এই যে অসংখ্যা সাম্প্রদায়িকতার ভাষা হয়ে যাচ্ছে! কালকেই (মঙ্গলবার) আমার পাশে বসেছিল ববি (কলকাতার মেয়র ফিরহাদ হাকিম)। ববি বলল, আমায় যখন ‘জনাব’ বলে আমি বাদ দিয়ে দিই। বলি ‘শ্রী’ লিখতে।’ তাঁর তো সেই ভাবনাটা রয়েছে। আমি কি মুসলমান দেখলেই ‘জনাব’ বলব?’’
শুভাপ্রসন্ন বরাবরই তৃণমূলের ‘ঘনিষ্ঠ’ হিসাবে পরিচিত। রাজ্যে ‘পরিবর্তন’-এর ডাক যাঁরা দিয়েছিলেন, এই শিল্পী ছিলেন তাঁদের মধ্যে অগ্রগণ্য। কিন্তু প্রকাশ্য মঞ্চে স্বয়ং মমতা তাঁর বক্তব্যের বিরোধিতা করার পরেও তিনি নিজের বক্তব্যে অনড় কেন? জবাবে শুভাপ্রসন্ন বলেন, ‘‘আমার তো বলার কোনও অসুবিধা নেই। আমার মধ্যে কোনও ‘হিপোক্রেসি’ (দ্বিচারিতা) নেই। আর মমতার সঙ্গে আমার যে সম্পর্ক, সেটা কালকেও বলেছেন, ‘অত্যন্ত শ্রদ্ধার’। সেই শ্রদ্ধার সম্পর্ক থেকে যাবে।’’
এমন মন্তব্যের পরে মমতার সঙ্গে তাঁর দূরত্ব তৈরি হতে পারে তো? প্রশ্ন শুনে শুভাপ্রসন্ন বলেন, ‘‘মমতার সঙ্গে সম্পর্কের যে গভীরতা, তাতে কোনও দিন দূরত্ব তৈরি হতে পারে না। আর মমতা অত ঠুনকো লোক নন। আমি সরাসরি কিছু বলতে পারি। মমতাও সরাসরি বলতে পারেন।’’ একই সঙ্গে তাঁর সংযোজন, ‘‘তৃণমূল কংগ্রেস তো আমার জীবিকা বা উপজীবিকা নয়। আমি ছবি আঁকি।’’
বাংলা ভাষায় ‘পানি’, ‘দাওয়াত’ শব্দ নিয়ে আপত্তি থাকলেও মমতার বক্তব্যে মুসলমান সম্প্রদায়ের মুখের ভাষা ব্যবহার নিয়ে অবশ্য অন্য অভিমত রয়েছে শুভাপ্রসন্নের। তাঁর কথায়, ‘‘সেটার একটা রাজনৈতিক কারণ রয়েছে। একটা বড় অংশের মুসলমান আমাদের এখানে থাকেন। তাঁরা তো অত বোদ্ধা নন।’’ মুসলমানদের ‘তোষণ’ করতেই এই ধরনের ভাষা ব্যবহার বলেও মনে করেন শুভাপ্রসন্ন। কারণ, তাঁর মতে, ‘‘রাজনীতিকরা তো ভোটের ভয় পান!’’