মঙ্গলবার কলেজ স্কোয়্যার থেকে রবীন্দ্র সদনের পথে নাগরিক সমাজের মিছিল। —নিজস্ব চিত্র।
এ এক অন্য ‘দেবীপক্ষ’-এর সূচনা! উৎসবের নয়, দ্রোহের। যেমনটা জুনিয়র ডাক্তারেরা লিখেছিলেন গত রবিবার ধর্মতলার রাস্তায়। মশাল হাতে তাঁরা জানিয়ে দিয়েছিলেন, নিহত চিকিৎসক বিচার না পেলে তাঁরা উৎসবে ফিরবেন না। রাস্তায় থেকেই আন্দোলন চালিয়ে যাবেন। তাঁদের পাশে থেকে আগের মতোই একের পর এক কর্মসূচি ঘোষণা করা হয়েছে নাগরিক সমাজের পক্ষে। কলকাতা থেকে জেলা— ঘরে বসে নয়, বরং পথে নেমে দেবীপক্ষের সূচনা দেখতে চাইছে তারা। অন্য দিকে, ‘রাত দখল’-এর ডাক দেওয়া সেই মেয়েরা দেবীপক্ষের ধারণাটাই ভাঙতে চান। তাঁদের দাবি, একটা পক্ষ ধরে নয়, বরং এই আন্দোলন চলুক সারা বছর। সারা বছর ধরে মেয়েরা যেন নিজেদের কথা বলতে পারেন, সেই সুযোগটাই করে দেওয়ার চেষ্টা করছেন তাঁরা।
মহালয়ার আগে নতুন করে পূর্ণ কর্মবিরতি শুরু করেছে রাজ্যের ২৩টি মেডিক্যাল কলেজের জুনিয়র ডাক্তারদের মিলিত মঞ্চ। সরকারের কাছে ১০ দফা দাবি তুলে ধরেছেন তাঁরা। জানিয়ে দিয়েছেন, দাবি পূরণে সুস্পষ্ট পদক্ষেপ না করা পর্যন্ত রাজ্যের প্রতিটি মেডিক্যাল কলেজে চলবে কর্মবিরতি। সেই আবহেই নির্যাতিতা চিকিৎসকের জন্য বিচার চেয়ে মঙ্গলবার বিকেলে কলেজ স্কোয়্যার থেকে রবীন্দ্র সদন পর্যন্ত মিছিল ছিল জুনিয়র এবং সিনিয়র ডাক্তারদের সংগঠনের। তাদের পাশে রয়েছেন ‘রাত দখল’-এর ডাক দেওয়া মেয়েদের সংগঠন ‘রিক্লেম দ্য নাইট, রিক্লেম দ্য রাইট’ থেকে সাধারণ মানুষ, যৌনকর্মী, রূপান্তরকামীরা। মিছিলে হেঁটেছেন মোহনবাগান, ইস্টবেঙ্গল, মহমেডানের সমর্থকেরাও। রাস্তায় হেঁটেছেন প্রাক্তন তৃণমূল সাংসদ জহর সরকার। ‘রাত দখল’-এর কর্মসূচি রয়েছে সিঁথির মোড়, রুবির মোড় এবং যাদবপুর ৮বি বাসস্ট্যান্ডে।
বুধবার মহালয়াতেও জুনিয়র ডাক্তারদের একটি পূর্বঘোষিত কর্মসূচি রয়েছে। কলেজ স্ক্যোয়ার থেকে ধর্মতলা পর্যন্ত মিছিল করার কথা তাঁদের। সেখানে জুনিয়র ডাক্তারদের পাশাপাশি শহর ও শহরতলির সাধারণ নাগরিকদের পা মেলাতে দেখা যাবে। যেমন দেখা গিয়েছিল আন্দোলনকারী জুনিয়র ডাক্তারদের আগের কর্মসূচিগুলিতেও। মিছিল শেষে ধর্মতলায় একটি সভাও করার কথা রয়েছে তাঁদের।
কিন্তু তার পরের দিনগুলিতে কোন পথে এগোবে প্রতিবাদ কর্মসূচি? তা নিয়ে এখনও কোনও সিদ্ধান্ত নেননি জুনিয়র ডাক্তারেরা। মঙ্গলবারের সাংবাদিক বৈঠকে জুনিয়র ডাক্তারদের প্রতিনিধি অনিকেত মাহাতো বলেছিলেন, “২ অক্টোবর আমাদের মিছিল রয়েছে। এই পর্যন্ত কর্মসূচি স্থির রয়েছে। পুজোর দিনগুলিতে কী হবে বা কী হবে না, সে বিষয়ে ওয়েস্ট বেঙ্গল জুনিয়র ডক্টরস’ ফ্রন্টের তরফে কোনও সুনির্দিষ্ট সিদ্ধান্ত এখনও নেওয়া হয়নি।”
গত ৯ অগস্ট আরজি কর মেডিক্যাল কলেজে এক চিকিৎসকের দেহ উদ্ধার হয়। তাঁকে ধর্ষণ এবং খুনের অভিযোগ উঠেছিল। ওই দিন থেকে কর্মবিরতির ডাক দিয়েছিলেন রাজ্যের জুনিয়র ডাক্তারেরা। প্রথম দিন থেকে তাঁদের পাশে ছিল নাগরিক সমাজ।
গত ১৪ অগস্ট মেয়েদের নিরাপত্তার দাবিতে ‘রাত দখল’-এর ডাক দেওয়া হয়েছিল কলকাতা-সহ রাজ্যের বিভিন্ন জায়গায়। মঙ্গলবার ‘অ্যাকাডেমি অফ ফাইন আর্টস’ চত্বরে আরও এক বার ‘রাত দখল’-এর কর্মসূচি রয়েছে মেয়েদের। রাত সাড়ে ১১টা থেকে ভোর সাড়ে ৪টে পর্যন্ত চলবে কর্মসূচি। ওই কর্মসূচির এক আয়োজক জানান, তাঁদের কাছে পিতৃপক্ষ আর দেবীপক্ষ আদতে একই, সবটাই এসেছে ‘পিতৃতান্ত্রিক’ ভাবনা থেকে। অ্যাকাডেমি চত্বরে একসঙ্গে বসে মেয়েরা সেই ‘পিতৃতান্ত্রিক’ ভাবনাই ভাঙতে চাইছেন বলে জানান তিনি। নিজেদের মতো করে অনুষ্ঠান করবেন মেয়েরা, যেখানে তুলে ধরবেন নিজেদের কথা। তার পর রাত ১টা থেকে ৩টে পর্যন্ত চলবে ‘রাতের বৈঠক’। সেখানে একে অন্যের সমস্যার কথা শুনবেন তাঁরা। নিজের এলাকায় একটি মেয়ে কী কী সমস্যার মুখে রোজ পড়েন, সেই কথা উঠে আসবে বৈঠকে। আয়োজকদের এক জনের কথায়, ‘‘আমরা এ ভাবে সমস্যার সমাধান করতে পারব না। কিন্তু তা চিহ্নিত অন্তত করতে পারব। যাঁরা সমস্যার সম্মুখীন হয়েছেন, লড়াইটা তাঁদের নিজেদেরই লড়তে হবে।’’
অন্য এক আয়োজক গার্গী মনে করেন, আন্দোলন থিতিয়ে গেলে মেয়েদের নিরাপত্তার অভাব দেখা দিতে পারে। তাঁদের প্রতিবাদ করার, নিজেদের কথা বলার জায়গাটা চলে যেতে পারে। তাই এই আন্দোলনকে তাঁরা জিইয়ে রাখতে চান।
বৃহস্পতিবার রাত ৯টা থেকে শ্যামবাজারে তাঁদের আরও একটি কর্মসূচি রয়েছে। সেখানে মেয়েরা তাঁদের হেনস্থার অভিজ্ঞতার কথা শোনাবেন। গার্গীর কথায়, ‘‘আরজি কর-কাণ্ডের আবহে যে আন্দোলন শুরু হয়েছে, তা মেয়েদের কথা বলার একটা সুযোগ করে দিয়েছে। আমরা ভেবেছিলাম, এলাকায় এলাকায় এ বার মেয়েদের যদি নিজেদের কথা বলার সুযোগ করে দেওয়া যায়! সেই ভাবনা থেকেই বৃহস্পতিবার রাতে শ্যামবাজারে কর্মসূচির ডাক দেওয়া হয়েছে।’’
অন্য এক আয়োজক মুনমুন বিশ্বাস মনে করিয়ে দিলেন, দেবীপক্ষ বলে এই কর্মসূচির ডাক দেওয়া হয়নি। বিষয়টি আগে থেকেই স্থির করা ছিল। ১৪ সেপ্টেম্বর যখন তাঁরা সাংবাদিক বৈঠক করেছিলেন, তখনই এই কর্মসূচির কথা জানিয়েছিলেন। পুজোর মণ্ডপে কোনও প্রতিবাদ কর্মসূচি করা যায় কি না, তা নিয়েও ভাবনাচিন্তা করছেন মেয়েরা।
আরজি কর-কাণ্ডের আবহে এ বছর অন্য রকম মহালয়া দেখতে চলেছে হুগলির চন্দননগরও। মঙ্গলবার রাত ৯টা থেকে ১২টা শহরের স্ট্র্যান্ডের জোড়াঘাটে ‘রাত দখল’-এর কর্মসূচি রয়েছে স্থানীয় নাগরিক এবং ছাত্রছাত্রীদের। তার আগে মঙ্গলবার সন্ধ্যায় চন্দননগরেরই বাগবাজার মোড়ে একটি নাগরিক সংগঠনের ডাকে এক ঘণ্টা অবস্থান বিক্ষোভ করেন স্থানীয়েরা। বুধবার সন্ধ্যায় চন্দননগরে গঙ্গার বিভিন্ন ঘাটে প্রদীপ ভাসিয়ে নির্যাতিতার আত্মার শান্তিকামনা করার ডাক দিয়েছে একটি সংগঠন।
বুধবার ভোর ৫টায় প্রতিবাদ মিছিলের ডাক দিয়েছে বৈদ্যবাটির নাগরিক সংগঠন। শ্রীরামপুরে বুধবার ‘ভোর দখল’-এর ডাক দিয়েছেন নাগরিকেরা। ভোর ৪টের সময় শ্রীরামপুরের বটতলা থেকে প্রদীপ হাতে শুরু হবে মিছিল। বুধবার সন্ধ্যায় প্রতিবাদ মিছিল রয়েছে রিষড়া, চুঁচুড়াতেও। নাগরিক সংগঠনগুলির তরফে জানানো হয়েছে, পুজোর সময়েও চলবে বিভিন্ন কর্মসূচি। যেমনটা রাজ্যের জুনিয়র ডাক্তারেরা স্লোগান দিয়েছিলেন, ‘তিলোত্তমার ভয় নাই, রাজপথ ছাড়ি নাই’।