বামেরা যখন শাসক ছিল, উপনির্বাচনে পরাস্ত হয়েছিল একাধিক জায়গায়। গ্রাফিক: আনন্দবাজার অনলাইন।
রাজ্যে সদ্যসমাপ্ত ছ’টি কেন্দ্রের উপনির্বাচনে ছক্কা হাঁকিয়েছে তৃণমূল। শাসকদলের সংগঠনের সামনে দাঁড়াতেই পারেনি বিরোধীরা। ফল ঘোষণার পরে বিরোধী দলনেতা শুভেন্দু অধিকারী অবশ্য বলেছেন, ‘‘এটা কোনও ভোটই নয়!’’ একই সুর শোনা গিয়েছে সিপিএম নেতা সুজন চক্রবর্তীর গলাতেও। বস্তুত, উপনির্বাচন নিয়ে সাধারণ ধারণাই হল, যে হেতু এই ভোটে সরকার বদলের সুযোগ থাকে না, তাই উপনির্বাচনে শাসকদলই জেতে। কিন্তু তথ্য এবং পরিসংখ্যান সে কথা বলছে না। সিঙ্গুর-নন্দীগ্রাম পর্বকে যদি বঙ্গ রাজনীতির পট পরিবর্তনের ‘সন্ধিক্ষণ’ হিসাবে ধরা হয়, তা হলে দেখা যাচ্ছে তার আগে এবং পরে তৎকালীন শাসক সিপিএম তথা বামেরা একাধিক উপনির্বাচনে পরাস্ত হয়েছিল। তৃণমূল জমানাতেও তাদের উপনির্বাচনে হারার নজির রয়েছে।
২০০৬ সালের বিধানসভা ভোটে ৫০ শতাংশের বেশি ভোট এবং ২৩৫টি আসন নিয়ে বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যের নেতৃত্বে সপ্তম বামফ্রন্ট সরকার প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। ঘটনাচক্রে, সেই ফল ঘোষণার সপ্তাহ তিনেকের মধ্যেই সিঙ্গুর আন্দোলনের ভিতপুজো হয়ে যায়। ২০০৭ সালের মার্চে নন্দীগ্রামে পুলিশের সঙ্গে সংঘর্ষে ১৪ জনের মৃত্যু এবং পরবর্তীকালে আবার সিঙ্গুর আন্দোলনের নতুন করে অক্সিজেন পাওয়া ‘বলশালী’ বামেদের জনভিত্তিতেই আঘাত হেনেছিল।
সিঙ্গুর পর্বেই স্পষ্ট হয়েছিল যে, উপনির্বাচন মানেই শাসকদের জয় নয়। বেশির ভাগ ক্ষেত্রে শাসকদল জেতে, এ ব্যাপারে কোনও সন্দেহ নেই। কিন্তু বিরোধীরাও জেতে। শাসকদল হারে।
পাঁশকুড়া লাইন
২০০০ সালে উপনির্বাচনে লোকসভা আসন হারাতে হয়েছিল শাসক বামেদের। তৃণমূল তৈরি হওয়ার পরে বামেদের প্রথম বিপাকে ফেলেছিল কেশপুর-গড়বেতা। সেই সময়ে সবং, পিংলা, চমকাইতলা থেকে শুরু করে হুগলির আরামবাগ, গোঘাট থেকে শুরু করে বাঁকুড়ার কোতুলপুর পর্যন্ত গোটা ‘করিডর’ ছিল রাজনৈতিক ভাবে উত্তপ্ত। সেই সময়েই অধুনালুপ্ত পাঁশকুড়া লোকসভা কেন্দ্রের সিপিআই সাংসদ গীতা মুখোপাধ্যায়ের মৃত্যুর পর উপনির্বাচন হয়। সেই ভোটে প্রাক্তন আমলা তৃণমূল প্রার্থী বিক্রম সরকারের কাছে পরাস্ত হয়েছিলেন গুরুদাস দাসগুপ্ত। যাকে ‘পাঁশকুড়া লাইন’ বলে অভিহিত করেছিলেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়।
জঙ্গলমহল
সিঙ্গুর-নন্দীগ্রামের পাশাপাশি জঙ্গলমহলে মাওবাদী সমস্যাও বুদ্ধদেবকে ‘বিড়ম্বিত’ করেছিল। পরবর্তীকালে সিপিএম তাদের দলীয় নথিতেও স্বীকার করেছিল, জঙ্গলমহলের আদিবাসী মহল্লায় তাদের গণভিত্তি ধীরে ধীরে দুর্বল হয়েছে। কিন্তু স্থানীয় স্তরের নেতৃত্বের জনবিচ্ছিন্নতার ফলে উপরের স্তরের নেতারাও গোড়ায় রোগ ধরতে ব্যর্থ হয়েছিলেন। যার অভিঘাত এখনও টের পাচ্ছে আলিমুদ্দিন স্ট্রিট। ২০০০ সালে একাধিক বিধানসভায় উপনির্বাচন হয়েছিল বাংলায়। তার মধ্যে তৎকালীন শাসক বামেদের অন্যতম হার ছিল জঙ্গলমহলের বিনপুরে। সিপিএমকে হারিয়ে বিধায়ক হয়েছিলেন ঝাড়খণ্ড পার্টির নরেন গোষ্ঠীর প্রার্থী চুনিবালা হাঁসদা। চুনিবালার জয়ের মধ্যে যে ভবিষ্যতের ইঙ্গিত ছিল, তা মানেন সিপিএম নেতাদের অনেকে। ঝাড়গ্রামের প্রাক্তন সিপিএম সাংসদ পুলিনবিহারী বাস্কের ঘনিষ্ঠ এক শিক্ষক নেতা বলেছিলেন, ‘‘পঞ্চায়েত স্তরের নেতাদের মনোভাবের কারণেই আমরা আমাদের জায়গা হারিয়েছি।’’
উপনির্বাচনে বাম-ধাক্কা
সিঙ্গুর-নন্দীগ্রাম পর্বের পরে বামেদের প্রথম নির্বাচনী ধাক্কা ছিল ২০০৮ সালের পঞ্চায়েত ভোট। অজস্র গ্রামপঞ্চায়েত, বেশ কিছু পঞ্চায়েত সমিতির পাশাপাশি পূর্ব মেদিনীপুর এবং দক্ষিণ ২৪ পরগনা জেলা পরিষদ হারাতে হয়েছিল বামেদের। ভোটপণ্ডিতদের অনেকেই বলেন, ওই ভোটই বাম পতনের সূচনা ঘটিয়েছিল। তার পর রাজ্যের তিনটি বিধানসভার উপনির্বাচনে হেরেছিল সিপিএম। ২০০৯ সালে জলপাইগুড়ির রাজগঞ্জে জিতেছিলেন খগেশ্বর রায়। খগেশ্বরই উত্তরবঙ্গের প্রথম তৃণমূল বিধায়ক। সেই বছরেই দক্ষিণ ২৪ পরগনার বিষ্ণুপুর পশ্চিম (আসন পুনর্বিন্যাসের ফলে সেই আসনটি এখন লুপ্ত) কেন্দ্র থেকে জিতেছিলেন তৃণমূলের মদন মিত্র। সুভাষ চক্রবর্তীর প্রয়াণের পরে তাঁর পূর্ব বেলছিয়া আসনে (সেই কেন্দ্রও এখন আর নেই) হেরে গিয়েছিলেন সিপিএমের প্রার্থী, সুভাষজায়া রমলা। তাঁকে হারিয়েছিলেন একদা সুভাষের ‘শিষ্য’ সুজিত বসু।
বিজেপির কাছে শাসক বামের হার
১৯৭৭ সাল থেকে ২০১১— বাংলায় ৩৪ বছর ক্ষমতায় ছিল বামেরা। তার মধ্যে সিঙ্গুর-নন্দীগ্রাম পর্ব তাদের কাছে সবচেয়ে ‘কঠিন’ ছিল সন্দেহ নেই। কিন্তু তার অনেক আগে আশি এবং নব্বইয়ের দশকেও ‘শাসক’ বামেদের উপনির্বাচনে পরাজয়ের নজির রয়েছে। ১৯৮৪ সালে খাস কলকাতায় বেলগাছিয়া কেন্দ্রে উপনির্বাচনে সিপিএমের থেকে আসন ছিনিয়ে নিয়েছিল কংগ্রেস। তখন জ্যোতি বসুর দ্বিতীয় সরকারের বয়স দু’বছর। সিপিএমের লক্ষ্মী সেনকে পরাস্ত করেছিলেন কংগ্রেসের অমর ভট্টাচার্য। ওই বছরেই বোলপুর বিধানসভা বাম শরিক আরএসপির থেকে ছিনিয়ে নেয় কংগ্রেস। শুধু কংগ্রেসই নয়। নব্বইয়ের দশকে উপনির্বাচনে বামেদের হারিয়েছিল বিজেপি। বাংলায় কার্যত ‘অস্তিত্বহীন’ বিজেপি ১৯৯৫ সালে উত্তর ২৪ পরগনার অশোকনগর বিধানসভার উপনির্বাচনে সিপিএমকে হারিয়ে দিয়েছিল। জিতেছিলেন বিজেপির বাদল ভট্টাচার্য।
তৃণমূলও ব্যতিক্রম নয়
মমতার নেতৃত্বে তৃণমূল সরকারে আসার পর উপনির্বাচনে তাদেরও হারের নজির রয়েছে। ২০১১ সালে কংগ্রেসের সঙ্গে জোট করে সরকার গড়েছিল তৃণমূল। প্রথম মন্ত্রিসভায় কংগ্রেসের অনেকে মন্ত্রীও হয়েছিলেন। কিন্তু দেড় বছর কাটতে না কাটতেই সেই জোট ভেঙে যায়। মহাকরণে দাঁড়িয়ে প্রথম ‘বিদ্রোহ’ ঘোষণা করেছিলেন কংগ্রেসের মন্ত্রী মনোজ চক্রবর্তী। তখন মুর্শিদাবাদের রেজিনগরের কংগ্রেস বিধায়ক হুমায়ুন কবীর মন্ত্রী। কংগ্রেস মমতার মন্ত্রিসভা ছাড়লেও হুমায়ুন থেকে গিয়েছিলেন। পরে তিনি মন্ত্রী থাকলেও বিধায়ক পদ থেকে ইস্তফা দেন। তৃণমূল উপনির্বাচনে রেজিনগরে টিকিট দেয় হুমায়ুনকে। কিন্তু হুমায়ুন হারেন তখন বিরোধী কংগ্রেসের কাছে। মন্ত্রিসভা ছাড়তে হয় হুমায়ুনকে।
২০১৬ সালে নদিয়ার কৃষ্ণগঞ্জে জিতেছিলেন তৃণমূলের সত্যজিৎ বিশ্বাস। কিন্তু ২০১৯ সালে তিনি খুন হন। কৃষ্ণগঞ্জের উপনির্বাচনে শাসক তৃণমূলকে হারিয়ে জিতেছিল বিজেপি। সেই বছরেই অর্জুন সিংহের ছেড়ে আসা ভাটপাড়া আসনের উপনির্বাচনে বিজেপির টিকিটে জিতেছিলেন তাঁর পুত্র পবন। ২০১৬ সালে অর্জুন ছিলেন তৃণমূল। কিন্তু উপনির্বাচনে সেই আসন ধরে রাখতে পারেনি শাসকদল। অর্জুন-পুত্রের কাছে পরাস্ত হন তৃণমূলের মদন।
তবে তৃণমূলের শাসনকালে সবচেয়ে আলোচিত উপনির্বাচন মুর্শিদাবাদের সাগরদিঘি। যেখানে বাম-কংগ্রেসের বিরোধী জোটের কাছে হেরেছিল শাসক তৃণমূল। মন্ত্রী সুব্রত সাহার মৃত্যুর পরে সাগরদিঘিতে উপনির্বাচন হয়েছিল। সংখ্যালঘু অধ্যুষিত সাগরদিঘিতে তৃণমূল হেরে গিয়ে বিড়ম্বনায় পড়েছিল। ভোটের ফলের পর দলের সংখ্যালঘু সেলের চেয়ারম্যান বদলে দিয়েছিলেন মমতা। সাগরদিঘির জয়ী বিধায়ক অবশ্য তিন মাসের মধ্যে তৃণমূলে যোগ দেন।
অর্থাৎ, উপনির্বাচনে শাসকের হারের নজির খুব কম নেই এ রাজ্যে। প্রশ্ন হল, তা সত্ত্বেও বিরোধীরা কেন হারের ‘দায়’ না নিয়ে ভাঙা ক্যাসেটের মতো ‘উপনির্বাচনে কেমন ভোট হয় জানা আছে’ বলে যাচ্ছে? তৃণমূল বা বাম জমানায় শাসকদল যখনই উপনির্বাচনে হেরেছে, দেখা গিয়েছে সংশ্লিষ্ট এলাকায় বিরোধীরা ন্যূনতম সংগঠন দাঁড় করাতে পেরেছে। তাতেই লড়াই দেওয়া সম্ভব হয়েছে। যেমন, সাগরদিঘিতে কংগ্রেসের সংগঠন ছিল। কিন্তু তা সত্ত্বেও সেখানে মাটি কামড়ে পড়েছিলেন কংগ্রেসের অধীর চৌধুরী। যার ফসল ঘরে তুলেছিল কংগ্রেস। কিন্তু সদস্যসমাপ্ত উপনির্বাচনে কোনও লড়াই-ই দিতে পারেনি বিরোধীরা। তৃণমূল নেতা কুণাল ঘোষ যেমন বলছেন, ‘‘সংগঠন নেই। লোক নেই। তাই এই সব নাকে কান্না কাঁদছে।’’