মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। —ফাইল ছবি।
আরজি কর-কাণ্ডে নাগরিক আন্দোলন জমাট বাঁধতে শুরু করেছিল অগস্টের ১২ তারিখ থেকে। তার পর থেকে ক্রমশই সেই আন্দোলন আকারে বড় হয়েছে এবং নতুন নতুন জায়গায় ছড়িয়ে পড়েছে। এই সময়কালে অন্তত দু’বার তৃণমূল তাদের সংগঠন নামিয়ে ওই আন্দোলন মোকাবিলার চেষ্টা করেছে। কিন্তু তা সে ভাবে দাগ কাটতে পারেনি। পারেনি যে, তা একান্ত আলোচনায় মানছেন শাসকদলের নেতারাও। শেষ পর্যন্ত কলকাতা পুলিশের কমিশনার-সহ অন্য এক পুলিশকর্তা এবং দুই স্বাস্থ্যকর্তাকে বদলি করেছেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। কিন্তু তাতেও পরিস্থিতি সামাল দেওয়া নিয়ে সংশয় রয়েছে শাসক শিবিরের অন্দরে।
উল্লেখ্য, তৃণমূল নেত্রী মমতাই আন্দোলন মোকাবিলায় সংগঠনকে নামানোর চেষ্টা করেছিলেন। শাসকদলের মধ্যে এখন আলোচনা, সংগঠনকে সে ভাবে নামানো গেল না বলেই কি ‘প্রশাসনিক বদল’ করে রাজ্য সরকারকে মাথা নোয়াতে হল? পাশাপাশি এই প্রশ্নও উঠছে যে, কেন সংগঠনকে নামানো গেল না।
গত ১৬ অগস্ট আরজি কর-কাণ্ডে বিচার চেয়ে পথে নেমেছিলেন মমতা। মৌলালি থেকে ধর্মতলা মিছিল করেছিলেন তৃণমূল নেত্রী। তার পরে সেই মঞ্চ থেকেই পর পর তিন দিন ব্লকে-ব্লকে মিছিল, ধর্না-অবস্থানের কর্মসূচি নির্দিষ্ট করে দিয়েছিলেন তিনি। কিন্তু তখন নাগরিক আন্দোলনের আঁচ গনগনে। তার সামনে শাসকদলের কর্মসূচিকে ‘ম্রিয়মান’ দেখিয়েছিল। ২৮ অগস্ট তৃণমূল ছাত্র পরিষদের প্রতিষ্ঠা দিবসের কর্মসূচি থেকেও মমতা ফের ছাত্র এবং মহিলা সংগঠনকে রাস্তায় নামতে বলেছিলেন। সেই কর্মসূচিও তেমন কোনও ‘ছবি’ তৈরি করতে পারেনি।
তৃণমূলের এক প্রবীণ নেতার কথায়, ‘‘দল তৈরি হয়েছে ২৬ বছর আগে। কিন্তু আমাদের সংগঠন এখনও ভোটের সংগঠন হিসাবেই রয়ে গিয়েছে। সঙ্কটকালীন পরিস্থিতিতে মোকাবিলা করার মতো সংগঠন এখনও গড়ে ওঠেনি।’’ দলের প্রথম সারির এক নেতার কথায়, ‘‘আরজি কর-কাণ্ডের প্রতিবাদ আন্দোলনে সাধারণ ছাত্রদের অংশগ্রহণ রয়েছে। কিন্তু দলের ছাত্র সংগঠন তা ধরতে পারেনি।’’ এর নেপথ্যে ‘সাংগঠনিক স্থবিরতা’কেই দায়ী করেছেন তিনি। তাঁর কথায়, ‘‘কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্র সংগঠন হওয়া উচিত চলমান। কিন্তু ভোট না হওয়ার ফলে পরীক্ষিত নেতৃত্ব তৈরি হচ্ছে না। ফলে সংগঠন কী বস্তু, তাঁরা অনুধাবনও করতে পারছেন না।’’
গত কয়েক বছর ধরেই তৃণমূলে সাংগঠনিক বিষয় দেখাশোনা করেন সর্বভারতীয় সাধারণ সম্পাদক অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়। আরজি কর-কাণ্ডের পরে অধিকাংশ সময়েই অভিষেক ‘সরে’ থেকেছেন। দলের ছাত্র-যুবদের একটি বড় অংশ তাঁকে মাঠে নামার আবেদন জানালেও মমতার সঙ্গে কয়েকটি বৈঠক এবং দলের একটি কর্মসূচিতে ভাষণ ছাড়া তাঁকে পাওয়া যায়নি। তবে কিছু ‘মোক্ষম’ সময়ে তিনি সমাজমাধ্যমে নিজের বক্তব্য জানিয়েছেন। কিন্তু দৈনন্দিন কাজকর্মে তাঁর ভাবনার ‘ছাপ’ দেখা যায়নি। সংগঠনকে ময়দানে নামানোর বিষয়ে অভিষেকের যে নিজস্ব ‘ছাঁচ’ রয়েছে, তা-ও দেখা যায়নি। তৃণমূলে কারও কারও এ-ও বক্তব্য, অভিষেক যদি এই পর্বে নিজের মতো করে ‘সক্রিয়’ থাকতেন বা তাঁকে থাকতে বলা হত, তা হলে সংগঠনকে অন্য ভাবে রাস্তায় নামানো যেত।
অনেকের মতে, প্রাথমিক ভাবে চেষ্টা হয়েছিল সংগঠন দিয়েই বিষয়টির মোকাবিলা করার। কিন্তু তা না করতে পারার ফলে নবান্নকে মাথা নোয়াতে হয়েছে। ১৩ বছরের শাসনকালে এই প্রথমবার কোনও আন্দোলনের সামনে এতটা ‘নমনীয়’ হয়েছএন মমতা। যাকে বিরোধীরা ‘নতজানু’ বলেই ব্যাখ্যা করছেন। কলকাতার পুলিশ কমিশনারকে বদল করতে হয়েছে। সরাতে হয়েছে এক পদস্থ পুলিশ অফিসারকে। স্বাস্থ্য দফতরের শীর্ষস্থানীয় দুই কর্তাকেও সরিয়ে দিতে হয়েছে। মমতা জমানায় এমন ‘নজির’ নেই।
তৃণমূলের এখন আলোচনার বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে, সাংগঠনিক ‘ব্যর্থতা’র পরে প্রশাসনিক ভাবে কি পরিস্থিতি সামাল দেওয়া যাবে? দলের এক সাংসদের বক্তব্য, ‘‘আন্দোলনের শুরু থেকে দেখলে দেখা যাবে, বারে বারে ইস্যু বদলেছে। নির্যাতিতার বিচারের দাবি কখনও কখনও পিছনের সারিতেও চলে যাচ্ছে। ফলে আন্দোলন কত দিন থাকবে বলা মুশকিল। তবে এই পরিস্থিতি থেকে আমাদের শিক্ষা নিতে হবে।’’ রাজ্যের এক মন্ত্রী মেনেই নিয়েছেন, ‘‘এখন কাছাকাছি বড় কোনও ভোট নেই। তা হলে আমাদের খেসারত দিতে হত। এখনও সময় আছে পরিস্থিতি শুধরে নেওয়ার। সামনের ছ’টি উপনির্বাচনে একটা আন্দাজ পাওয়া যাবে অবশ্য।’’ প্রথম সারির এক নেতা মনে করছেন, তৃণমূলের বিরুদ্ধে ১৩ বছরের ‘প্রতিষ্ঠান বিরোধিতা’ জমেছে। আরজি কর-কাণ্ড সেই বারুদের স্তূপে একটা দেশলাই কাঠি জ্বালিয়ে দিয়েছে মাত্র। প্রশাসনিক রদবদল করে আপাতত ‘ব্যথা’ কমানো গেলেও যেতে পারে। তবে দ্রুত ‘এক্স রে’ করে দেখা প্রয়োজন হাড় ভেঙেছে কি না। দলের অন্য একাংশের বক্তব্য, নাগরিক আন্দোলনে সাফল্যের যে ‘স্বাদ’ বাংলা পেয়েছে এবং প্রশাসনিক রদবদলে যে ভাবে ‘জয়’ দেখছেন, তা ভবিষ্যতের জন্য সঙ্কেত।