(বাঁ দিকে) সুজয়কৃষ্ণ ভদ্র, সঞ্জীব মুখোপাধ্যায় (ডান দিকে)। —ফাইল ছবি।
সুজয়কৃষ্ণ ভদ্র ওরফে ‘কালীঘাটের কাকু’ আপাতত নিয়োগ দুর্নীতি মামলায় জেলের ঘানি টানছেন। তাঁকে বঙ্গ রাজনীতি যত না ‘সুজয়কৃষ্ণ’ নামে চেনে, তার চেয়ে বেশি তিনি ‘কালীঘাটের কাকু’ নামেই খ্যাত। সম্প্রতি বঙ্গ রাজনীতিতে আরও এক কাকুর আবির্ভাব ঘটেছে। কেউ তাঁকে বলছেন, ‘শ্মশানঘাটের কাকু’, কেউ আবার বলছেন ‘পানিহাটির কাকু’। এই কাকু আরজি করের নির্যাতিতার পাশের বাড়ির বাসিন্দা। তার নাম সঞ্জীব মুখোপাধ্যায়।
সঞ্জীবকে ‘কাকু’ বলেই সম্বোধন করতেন নির্যাতিতা। এক সময়ে তিনি ছিলেন সিপিএমের কাউন্সিলর। তার পর ভোটে হেরে গিয়ে বেশ কয়েক বছর ‘দলহীন’। ২০১৯ সালে যোগ দেন তৃণমূলে। সেই যোগদান পর্বে ছিলেন পানিহাটির তৃণমূল বিধায়ক নির্মল ঘোষ (নান্টু) এবং জ্যোতিপ্রিয় মল্লিক। প্রথম জনকে আরজি করের ধর্ষণ এবং খুনের মামলায় সোমবার জিজ্ঞাসাবাদ করছে সিবিআই। আর দ্বিতীয় জন খাদ্য দুর্নীতি মামলায় আপাতত জেলে।
প্রসঙ্গত, সঞ্জীব কখনও সিপিএমের দলীয় সদস্য ছিলেন না। অথচ ২০০৮ সালে তাঁকেই পানিহাটির ৩৪ নম্বর ওয়ার্ডে প্রার্থী করেছিল সিপিএম। কেন? সঞ্জীবের দাবি, তিনি সমাজসেবা করতেন। আগেও দু’বার সিপিএম ভোটে দাঁড়ানোর প্রস্তাব দিয়েছিল। কিন্তু তিনি প্রত্যাখ্যান করেছিলেন। অবশেষে ২০০৮ সালে রাজি হন ভোটে দাঁড়াতে। শর্ত ছিল একটাই। তাঁর কথায়, ‘‘আমি বলেছিলাম, জনপ্রতিনিধি হিসাবে আমি দায়িত্বপালন করতে পারি। কিন্তু সংগঠন করতে পারব না। তাতে সেই সময়কার জ়োনাল নেতৃত্ব রাজি হয়েছিলেন। আমায় বলেছিলেন, তুমি কাউন্সিলরগিরিটাই ভাল করে করো।’’ ২০১৩ সালেও সিপিএমের হয়ে ভোটে দাঁড়িয়েছিলেন সঞ্জীব। কিন্তু হেরে যান।
পানিহাটির যে এলাকায় নির্যাতিতার বাড়ি, সেই এলাকার সিপিএম সূত্রে জানা গিয়েছে, যে হেতু সঞ্জীবের ‘প্রতিপত্তি’ রয়েছে, তাই তাঁকে পুরভোটে দল টিকিট দিয়েছিল। এক নেতার কথায়, ‘‘সঞ্জীবকে টিকিট দেওয়ার কারণ ছিল একটাই— উনি নিজের ভোটের খরচ নিজেই করতে পারতেন। দলকে মাথা ঘামাতে হত না।’’ সেই সময়ে কারা তাঁর ‘অনুপ্রেরণা’ ছিলেন, সে কথা বলতে গিয়ে গোপাল ভট্টাচার্য, তানিয়া চক্রবর্তী, হরিপদ দাস, শান্তি ঘটকদের নাম গড়গড় করে বলে গেলেন ‘কাকু’ সঞ্জীব। সিপিএম সূত্রে জানা গিয়েছে, প্রাক্তন বিধায়ক গোপালের সঙ্গে সঞ্জীবের ‘সখ্য’ ছিল। ব্যারাকপুরের এক নেতার দাবি, গোপালের সুপারিশেই ২০০৮ সালে সঞ্জীবকে টিকিট দেওয়া হয়েছিল। যে গোপালের কথা আত্মজীবনীতে উল্লেখ করেছিলেন স্বয়ং জ্যোতি বসু।
সঞ্জীব পেশায় ব্যবসায়ী। বাংলার বাইরেও তাঁর ব্যবসার কাজ চলে। জানা গিয়েছে, মূলত বৈদ্যুতিক প্রকল্পে ঠিকাদারি করেন তিনি। পাশাপাশি খেলা, মেলা, গরিব মানুষের বিয়ে দেওয়া, আপদে-বিপদে দাঁড়ানো— এলাকায় ‘সমাজসেবী’ ভাবমূর্তি রয়েছে তাঁর। সঞ্জীব জানিয়েছেন, আরও ভাল করে সেই কাজ করতেই তিনি ২০১৯ সালে তৃণমূলে যোগ দিয়েছিলেন। এলাকায় তিনি বিধায়ক ‘নির্মল-ঘনিষ্ঠ’ হিসাবেই পরিচিত। সঞ্জীব অকপটেই বলছেন, সমাজসেবাই তাঁর ‘ইউএসপি’। তিনি ওই কাজ করে থাকেন।
নির্যাতিতার দেহ দাহ করা হয়েছিল পানিহাটি শ্মশানঘাটে। সেই নথিতে সঞ্জীবের সই রয়েছে। ৯ অগস্ট রাতে পানিহাটির শ্মশানঘাটে অনেকের সঙ্গে ছিলেন সঞ্জীব। যেমন ছিলেন বিধায়ক নির্মলও। ইতিমধ্যেই অভিযোগ উঠেছে, নির্যাতিতার দেহ ‘তড়িঘড়ি’ দাহ করার জন্য সেই রাতে পরিবারের উপর ‘চাপ’ তৈরি করা হয়েছিল। রবিবার সিবিআই আধিকারিকদের সামনে হাজিরা দিয়ে বেরিয়ে নির্যাতিতার ময়নাতদন্তের সময়ে উপস্থিত চিকিৎসক অপূর্ব বিশ্বাস দাবি করেছেন, প্রাক্তন এক কাউন্সিলর তাঁকে হুমকি দিয়েছিলেন, তাড়াতাড়ি ময়নাতদন্ত শেষ না করলে রক্তগঙ্গা বইয়ে দেবেন! অপূর্ব এ-ও জানিয়েছিলেন, তাঁর যত দূর মনে পড়ছে, ওই ব্যক্তি নিজেকে নির্যাতিতার ‘কাকু’ বলে পরিচয় দিয়েছিলেন।
সঞ্জীব অবশ্য দাবি করছেন, ‘‘সেখানে সেই সময়ে আমার এ সব কথা বলার অবস্থাই ছিল না। অত পুলিশ, স্বাস্থ্য দফতরের শীর্ষ আধিকারিক, অত ছাত্রছাত্রী— আমি ময়নাতদন্ত কখন হবে কি হবে না, সে কথা বলার কে?’’ তবে ‘কাকু’র ভূমিকা নিয়ে নানা মহল থেকে প্রশ্ন উঠছে। আর ‘কাকু’ বলছেন, তাঁর মান-সম্মান ধুলোয় মিশে যাচ্ছে। তিনি চান সিবিআই তাঁকে ডাকুক। তিনি সব বলবেন। সিবিআইয়ের দল যে দিন নির্যাতিতার বাড়িতে গিয়েছিল, সে দিন সেখানে ছিলেন ‘কাকু’ সঞ্জীবও। তিনি জানিয়েছেন, ওই দিন তিনি কেন্দ্রীয় তদন্তকারী সংস্থার আধিকারিকদের যা জানানোর জানিয়েছিলেন।
পানিহাটির তৃণমূলে কান পাতলে শোনা যাচ্ছে, সেই রাতে কাকুর পাশাপাশি আরও দুই কাউন্সিলরের ‘সক্রিয়তার’ কথা। এক ‘প্রভাবশালী’ নেতার ছেলে সেই রাতে কী ভূমিকা নিয়েছিলেন, তা নিয়েও গুঞ্জন শুরু হয়েছে। বিশেষত, বিধায়ক নির্মলকে সিবিআই তলবের পর তা আরও জোরালো হয়েছে। এ সবের মধ্যেই ‘কাকু’র বক্তব্য, ‘‘আমায় টেনে এনে ফোকাস ঘুরিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করা হচ্ছে।’’
তবে তিনি যে ‘নজরে’ রয়েছেন, তা বিলক্ষণ জানেন ‘কাকু’ও। যে ‘কাকু’ সমাজসেবী থেকে হয়েছিলেন সিপিএম কাউন্সিলর। তার পরে কয়েক বছর রাজনৈতিক সংস্পর্শ এড়িয়েই ছিলেন। ২০১৯ সালে ফের তৃণমূলে। সিপিএম হোক বা তৃণমূল জমানা— সঞ্জীব একই রকম। আরজি কর-কাণ্ডে তাঁকে ঘিরে তৈরি হয়েছে অনেক প্রশ্ন। বঙ্গ রাজনীতিতে আপাতত দ্বিতীয় ‘কাকু’ নিয়ে আলোড়িত।