Recruitment Scam

একা কুন্তলই ১০০ কোটি! সস্ত্রীক নাম‘জালিয়াতিও’

চার্জশিটে ইডি-র তদন্তকারীদের দাবি, শুধু কুন্তল একা নন, তাঁর স্ত্রী, আত্মীয়-সহ ঘনিষ্ঠ ন’জন বসে ছিলেন ২০১৪ সালের টেটে। তাঁদের কেউই পাশ করতে পারেননি।

Advertisement

শুভাশিস ঘটক

কলকাতা শেষ আপডেট: ০৭ এপ্রিল ২০২৩ ০৭:১৫
Share:

তৃণমূলের বহিষ্কৃত যুব নেতা কুন্তল ঘোষ। প্রতীকী ছবি।

প্রাথমিকে শিক্ষক নিয়োগের পরীক্ষা টেট (২০১৪) দিয়েও তিনি কৃতকার্য হতে পারেননি। চাকরিও পাননি স্কুলে। কিন্তু তার পরেই প্রাথমিক শিক্ষা পর্ষদের ওয়েবসাইট ‘হ্যাকিংয়ের’ মাধ্যমে সেই যে বাঁকা পথে নিয়োগের খেলায় মাতলেন, তাতে তৃণমূলের বহিষ্কৃত যুব নেতা কুন্তল ঘোষের আকাশছোঁয়া সাফল্য তাদেরও অবাক করে দিয়েছে বলে জানাচ্ছে ইডি। সম্প্রতি পেশ করা চার্জশিটে তাদের অভিযোগ, চাকরির টোপ দিয়ে একা কুন্তলই কর্মপ্রার্থীদের কাছ থেকে প্রায় ১০০ কোটি টাকা তুলেছিলেন! এত দিন যে-অঙ্কটা ঘোরাফেরা করছিল ৩০ কোটি টাকার আশেপাশে।

Advertisement

হ্যাকিংয়ের পাশাপাশি ছিল নিয়োগ পরীক্ষার ‘ওএমআর শিট’ বা উত্তরপত্র জালিয়াতি। তদন্তকারীদের সবিস্ময় প্রশ্ন, হুগলি জেলার এক জন যুব নেতা যদি বাজার থেকে এত টাকা তুলে থাকেন, তা হলে গোটা রাজ্য থেকে মোট কত টাকা তোলা হয়েছিল? এক ইডি-কর্তার দাবি, হুগলি জেলায় শুধু কুন্তল নন, তাঁর সঙ্গী, শাসক দল থেকে সদ্য-বহিষ্কৃত অন্য যুব নেতা শান্তনু বন্দ্যোপাধ্যায়ও চাকরির টোপ দিয়ে বাজার থেকে দেদার টাকা তুলেছিলেন। ফলে সব মিলিয়ে নিয়োগ দুর্নীতিতে লেনদেনের সামগ্রিক পরিমাণ কত হতে পারে, তা নিয়ে জল্পনা বেড়েছে ইডি-র অন্দরেই।

চার্জশিটে ইডি-র তদন্তকারীদের দাবি, শুধু কুন্তল একা নন, তাঁর স্ত্রী, আত্মীয়-সহ ঘনিষ্ঠ ন’জন বসে ছিলেন ২০১৪ সালের টেটে। তাঁদের কেউই পাশ করতে পারেননি। তাঁদের কারও চাকরি হয়নি প্রাথমিক স্কুলে। প্রাথমিক শিক্ষা পর্ষদের ওয়েবসাইটে ফল বেরোলে দেখা যায়, সেখানে কৃতকার্যদের তালিকায় তাঁদের নাম নেই। শিক্ষা শিবির-সহ বিভিন্ন মহলের পর্যবেক্ষণ, এই সামগ্রিক ব্যর্থতা থেকেই চাকরি বিক্রির চক্রের পত্তন কি না, সেটা মনস্তাত্ত্বিক অন্বেষণের গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হতে পারে।

Advertisement

চার্জশিটে ইডি-র অভিযোগ, নিয়োগ পরীক্ষায় ফেল করার পরেই পর্ষদের ওয়েবসাইট হ্যাক করেন কুন্তল। শুরু হয় যোগ্য প্রার্থীদের জায়গায় অযোগ্য প্রার্থীদের নাম ঢোকানোর খেল্‌। ইডি-র অভিযোগ, নাম-জালিয়াতির কাজটা ঠিকঠাক করতে পারছেন কি না, তা দেখার জন্য কুন্তল পরীক্ষামূলক ভাবে প্রথমে যোগ্য প্রার্থীদের নামের জায়গায় নিজের তো বটেই, সেই সঙ্গে স্ত্রী, দুই শ্যালিকা-সহ ঘনিষ্ঠ ন’জন ফেল করা আত্মীয়ের নাম ঢুকিয়ে দেন। সেই পরীক্ষা ‘সফল’ হয়। তদন্তে ইডি জেনেছে, টেটে অকৃতকার্য হলেও ওই ন’জনকে অন্তত দু’মাস ধরে পর্ষদের ওয়েবসাইটে ‘পাশ’ হিসেবে দেখানো হচ্ছিল। তার পরে সাইট থেকে সেই নামগুলি মুছে দেন কুন্তল।

চার্জশিটে ইডি-র অভিযোগ, ওয়েবসাইট হ্যাক করার পরীক্ষা সফল হওয়ার পরেই কুন্তল চাকরির প্রতিশ্রুতি দিয়ে অযোগ্য প্রার্থীদের কাছ থেকে টাকা তুলতে শুরু করেন। যাঁরা টাকা দিতেন, তাঁদের নাম হ্যাক করে ঢুকিয়ে দেওয়া হত পর্ষদের সাইটে। বিশ্বাস অর্জন করতে কুন্তল সেই সব অযোগ্য প্রার্থীকে সাইটে তাঁদের নাম দেখিয়ে দিতেন। এমনকি ওয়েবসাইটের প্রতিলিপিও তুলে দিতেন অযোগ্য প্রার্থীদের হাতে। ইডি সূত্রের দাবি, একই সঙ্গে জাল ‘অফার লেটার’ বা নিয়োগপত্রও তুলে দেওয়া হত অযোগ্য প্রার্থীদের হাতে। তদন্তকারীদের অভিযোগ, কুন্তল নিজে ভাল ভাবেই জানতেন যে, ওঁরা কোনও দিন চাকরি পাবেন না।

চার্জশিটের ২৬ নম্বর পাতায় ইডি-র তরফে জানানো হয়েছে, তাদের জেরার মুখে এই সাইট-কারচুপির যাবতীয় অভিযোগ বেসরকারি কলেজ সংগঠনের নেতা তাপস মণ্ডলের ঘনিষ্ঠ গোপাল দলপতির উপরে চাপিয়ে দিয়েছিলেন কুন্তল।

তবে গোপালের দাবি, তিনি নির্দোষ। গোপাল বলেন, ‘‘কুন্তল ও অরবিন্দ নামে তাঁর দূর সম্পর্কের এক ভাই ওয়েবসাইট কারচুপি করতেন বলে শুনেছি। ওই সব বিষয়ের সঙ্গে আমার কোনও যোগসূত্র নেই। কুন্তল মিথ্যা বয়ান দিয়ে আমাকে ফাঁসানোর চেষ্টা করছেন। কুন্তল ও তাপসের মুখোমুখি বসিয়ে আমাকে জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়েছিল। আমি দু’জনের সামনে ইডি-র তদন্তকারীদের সব বলেছি। তার ভিডিয়ো রেকর্ডিং করা হয়েছে।’’

চার্জশিটে তদন্তকারীদের দাবি, নিয়োগ দুর্নীতিতে প্রাক্তন শিক্ষামন্ত্রী পার্থ চট্টোপাধ্যায়, শিক্ষাসচিব মণীশ জৈন, পার্থের দুই ব্যক্তিগত সচিব সুকান্ত আচার্য ও প্রবীর বন্দ্যোপাধ্যায় নিয়োগ দুর্নীতিতে বৃহৎ চক্রের অংশীদার হিসেবে কাজ করেছেন। পার্থ শিক্ষামন্ত্রী থাকাকালেই ২০১৮ সালের জুন থেকে এখনও পর্যন্ত শিক্ষাসচিবের পদে রয়েছেন মণীশ। সুকান্ত ২০১১ সালে পার্থ শিল্পমন্ত্রী হওয়া থেকেই তাঁর সঙ্গে ছিলেন। পরে পার্থ ২০১৪ সালের মে মাসে শিক্ষা দফতরে এলে তাঁর সঙ্গেই এসেছিলেন সুকান্ত। আবার পার্থের সঙ্গেই ২০২১ সালে শিল্প দফতরে ফিরে যান।

চার্জশিটের ৭৪ নম্বর পাতায় ইডি দাবি করেছে, ওই চক্রকে ব্যবহার করেই কুন্তল চাকরি বিক্রি করে প্রায় ১০০ কোটি টাকা তুলেছিলেন। আর সেই টাকার একটা মোটা অংশ দিয়ে দামি গাড়ি কিনে দিয়েছিলেন টালিগঞ্জের বিভিন্ন অভিনেতা-অভিনেত্রীকে। টাকার একাংশ তিনি খরচ করেছিলেন শাসক দলের বিভিন্ন রাজনৈতিক কার্যকলাপে।

চার্জশিটে তদন্তকারীদের আরও দাবি, জেল হেফাজতে থাকা প্রাথমিক শিক্ষা পর্ষদের অপসারিত সভাপতি মানিক ভট্টাচার্য বেশ কয়েক বার তাঁকে ধমক দিয়েছিলেন বলেও জেরায় জানিয়েছেন কুন্তল। কিন্তু কেন মানিক তাঁকে বকেছিলেন, সেটা তিনি স্পষ্ট করেননি। পার্থ ও মানিকের সঙ্গে যোগসাজশে কুন্তল টাকার বিনিময়ে বেসরকারি বিএলএড ও ডিএলএড কলেজের অনুমোদনের ব্যবস্থাও করেছিলেন বলে দাবি ইডি-র। কিন্তু এই অনুমোদনের বিষয়ে শিক্ষাসচিব মণীশের ভূমিকা এখনও তেমন স্পষ্ট নয় বলেজানান তদন্তকারীরা।

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement