মেদিনীপুরে কংসাবতীর গান্ধীঘাটে তৈরি হয়েছে রাম-সীতার নতুন মন্দির। ছবি: সৌমেশ্বর মণ্ডলয়।
কংসাবতী নদীর তিরে গান্ধীঘাট। তার পাশে একটি ছোট মন্দির। সেই মন্দিরে হনুমানের সঙ্গে ছিল রাম-সীতার মূর্তিও। যদিও পুজো মিলত মূলত রামভক্তেরই। অযোধ্যায় রামমন্দির নির্মাণের আবহে মেদিনীপুর শহরের সেই কয়েক দশক পুরনো মন্দিরের সংস্কার করা হল। তা সেজে উঠছে নতুন করে। উদ্বোধনও হবে অযোধ্যার মন্দিরের সাত দিন আগে, ১৫ জানুয়ারি সংক্রান্তির দিনে। পুরসভার টাকায় তৈরি এই মন্দিরটি নিয়ে যথারীতি প্রশ্ন উঠেছে, জনগণের উন্নয়নের টাকায় কেন ধর্মস্থান সংস্কার করা হবে? একই প্রশ্ন উঠেছিল, পূর্ব মেদিনীপুরের দিঘায় রাজ্যের টাকায় এবং হিডকোর তত্ত্বাবধানে জগন্নাথ মন্দির গড়া নিয়েও।
মেদিনীপুর পুরসভার তৃণমূলের পুরপ্রধান সৌমেন খান অবশ্য দাবি করেছেন, তাঁরা পুর-আয়ের অর্থে শুধু মন্দির নয়, অন্য ধর্মস্থানেরও সংস্কার করেছেন। যদিও বিজেপি শাসক দলকে বিঁধতে ছাড়েনি। মেদিনীপুরের সাংসদ দিলীপ ঘোষের খোঁচা, ‘‘এখন বড় মন্দির করছেন। এত দিন করেননি কেন!’’ শিক্ষাবিদদের একাংশের আবার বক্তব্য, এই টাকা শিক্ষা, স্বাস্থ্য, খাদ্যের মতো ক্ষেত্রে খরচ করা উচিত। তাঁরা মনে করিয়ে দিচ্ছেন, দেশ সংবিধানগত ভাবে ধর্মনিরপেক্ষ। তাই সরকারি উদ্যোগে এমন কাজকরা অনুচিত।
অযোধ্যার রামমন্দির উদ্বোধন হবে ২২ জানুয়ারি। এর মধ্যে সেই আবহে দেশের সঙ্গে রাজ্যেও নানা কর্মসূচি নেওয়া শুরু হয়েছে। এই ক্ষেত্রে অগ্রণী অবশ্যই বিজেপি। বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলি উদ্বোধনে অংশ নেবে কি না, তা এখনও সবার ক্ষেত্রে স্পষ্ট নয়। এমন পরিস্থিতিতে ইতিহাস রক্ষার যুক্তি দেখিয়ে ‘রামমন্দির’ সংস্কার করে ফেলল মেদিনীপুর পুরসভা। যা তারা ‘উন্নয়নের অংশ’ বলেই ব্যাখ্যা করছে।
শহর মেদিনীপুরের একপাশ দিয়ে বয়ে গিয়েছে কংসাবতী নদী। ইতিহাসবিদদের একাংশের মতে, ১৯৪৮ সালের ১২ ফেব্রুয়ারি এখানে মোহনদাস কর্মচন্দ গান্ধীর চিতাভস্ম ভাসানো হয়। তাই এই নদীঘাটের নাম গান্ধীঘাট। সৌন্দর্যায়নের নামে, ‘তর্পণ’ প্রকল্পেঘাটটিকে নতুন করে বাঁধানো হয়েছে। পুরসভার যুক্তি, আগে থেকেই এখানে রাম-সীতা ও মহাবীর হনুমানের ছোট মন্দির ছিল। সেই মন্দিরটি আরও বড় আকারে করা হয়েছে। সব মিলিয়ে ব্যয় হচ্ছে ৫০ লক্ষ টাকা।
পুরসভার বক্তব্য, এখানকার ইতিহাস বাঁচিয়ে রাখতেই মন্দির তৈরিতে ‘সহযোগিতা’ করা হয়েছে। পুরপ্রধান সৌমেন বলেন, ‘‘গান্ধীঘাটের কাছে রাম-সীতা, মহাবীর মন্দির নির্মাণ করেছি আমরা। পৌষ সংক্রান্তি আমাদের কাছে একটি পবিত্র দিন। ওই দিনই আমরা মন্দির প্রতিষ্ঠা করব।’’ রাজ্যের অধিকাংশ মন্দিরের মতো এই মন্দিরটিও মহাবীর মন্দির নামেই খ্যাত, জানালেন স্থানীয়েরা। এখানে নির্দিষ্ট সেবাইত নেই। ইচ্ছুকেরা যান। এমনই একজন রবিদত্ত শর্মা বলেন, ‘‘মন্দিরে হনুমান চালিশা পাঠ করি। আগের মন্দিরটা ভাঙা পড়েছে। পুরপ্রধান উদ্যোগী হয়ে এই মন্দিরটা বানিয়ে দিয়েছেন।’’
বিজেপির নেতা তথা সাংসদ দিলীপ ঘোষ রাজনৈতিক বিতর্ক উস্কে বলেছেন, ‘‘সারা দেশে রামমন্দির প্রতিষ্ঠা হোক, এত দিন আমরাই চেয়েছি। মানুষের সমর্থন পেতেএখন সেই পথ সকলে অবলম্বন করছে।’’ তাঁর আরও দাবি, রাজ্যের নয়, কেন্দ্রের টাকাতেই সেজে উঠেছে গান্ধীঘাট। জেলা বিজেপির মুখপাত্র অরূপ দাসের মন্তব্য, ‘‘বাংলার রাজনীতি রামময় হয়ে গিয়েছে। তবে মানুষ রামের প্রকৃত পূজারীকেইভোট দেবেন।’’
তৃণমূলের পুরপ্রধান মনে করাচ্ছেন, ‘‘কারবালা মাঠের উন্নয়ন করেছি। গির্জার কাছে আলো লাগিয়েছি। রাস্তা করেছি। মন্দির নির্মাণেও সহযোগিতা করেছি।’’
শিক্ষাবিদ তথা বিদ্যাসাগর বিশ্ববিদ্যালয়ের ভূগোলের অধ্যাপক প্রসেনজিৎ আচার্য কিন্তু মনে করেন, ‘‘মন্দির, মসজিদ, গির্জা নির্মাণে সময় কিংবা অর্থ ব্যয় করা সরকারের কাজ নয়। সেটা কেন্দ্র হোক বা রাজ্য। আমাদের দেশ ধর্মনিরপেক্ষ। সেখানে সরকারের ধর্ম হবে শিক্ষা, স্বাস্থ্য,খাদ্যে জোর দেওয়া। কর্মসংস্থানে গুরুত্ব দেওয়া। নতুন কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয় গড়া।’’
শিক্ষকমহলের একাংশের প্রশ্ন, কিন্তু সরকারের ধর্মের কথা কি এখন রাজনৈতিক নেতাদের কানে ঢুকবে?