Amit Shah’s Kolkata rally

বিজেপিকে হতাশ করলেন শাহ, শাহকেও হতাশ করল রাজ্য বিজেপি, ধর্মতলায় কর্মখালি, নেই শাহি-জোশ!

লক্ষ লোক জমায়েতের লক্ষ্য নিয়ে ধর্মতলায় নেমেছিল বিজেপি। তেমনটা আশা করেই এসেছিলেন শাহ। কিন্তু সেই সভায় ‘শাহি-জোশ’ দেখা গেল না। বিজেপি যে চেহারায় সভা করতে চেয়েছিল তেমনটা হয়ে উঠল কি!

Advertisement

আনন্দবাজার অনলাইন সংবাদদাতা

কলকাতা শেষ আপডেট: ২৯ নভেম্বর ২০২৩ ১৯:৩৭
Share:

ধর্মতলায় সুকান্ত মজুমদার ও শুভেন্দু অধিকারীর সঙ্গে অমিত শাহ। — নিজস্ব চিত্র।

অমিত শাহ এলেন, দেখলেন, বললেন। কিন্তু মন জয় করতে পারলেন না। পক্ষান্তরে, সভায় আসা বিজেপির নেতা থেকে কর্মী-সমর্থকেরা যে কথা শুনতে চেয়েছিলেন, যেমন উত্তেজনা চেয়েছিলেন, তা-ও পেলেন না। শহর কিংবা গাঁ-গঞ্জ থেকে আসা বিজেপির জমায়েতকে হতাশা নিয়েই বাড়ি ফিরতে হল। কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী যা বললেন, তার বেশিটাই বহুশ্রুত। বাংলায় এর আগে অনেক সভাতেই এই সব কথা বলে গিয়েছেন অমিত। ‘নতুন’ বলতে শুধু দুর্নীতি অভিযোগে গ্রেফতার হওয়া তৃণমূলের তিন নেতা পার্থ চট্টোপাধ্যায়, অনুব্রত মণ্ডল, জ্যোতিপ্রিয় মল্লিকদের নামোচ্চারণ। সেই প্রেক্ষিতে তৃণমূল তথা মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে কিছুটা চ্যালেঞ্জের সুরে বার্তা দেওয়া। ফলে শীত বিকেলের বিষণ্ণতার সঙ্গে মিশে রইল অনেক আশা নিয়ে আসা মানুষের হতাশাও। সাধারণ ভাবে শাহের সভায় যে ‘জোশ’ দেখা যায়, বুধবার সেটা দেখতে পেল না ধর্মতলা।

Advertisement

হতাশ হয়েছেন শাহও। লক্ষ মানুষের জমায়েত হবে জেনেই তো সদ্য পাঁচ রাজ্যের প্রচার শেষ-করা শাহ কলকাতায় আসার বিষয়ে রাজি হয়েছিলেন। কিন্তু কোথায় কী! সামনের দিকে চেনামুখের ভিড় বাদ দিলে পিছনের দিকটা ন্যাড়া ন্যাড়া। রাজ্য বিজেপির নেতারা সমাগমের সংখ্যা নিয়ে যে দাবিই করুন না কেন, শাহের চোখকে ফাঁকি দেওয়া সম্ভব হয়নি। প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী তো শাহকে সাধে ‘সেনাপতি’ আখ্যা দেননি! জাতীয় রাজনীতিতে তাঁকেই সবচেয়ে বড় সংগঠক বলে দাবি করে গেরুয়া শিবির।

কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর সফরসূচিতে বলা ছিল, তিনি বেলা পৌনে ২টো নাগাদ মঞ্চে উঠবেন। মঞ্চ ছাড়বেন দুপুর সওয়া ৩টে নাগাদ। বাস্তবে দেখা গেল, তার অন্তত ৪৫ মিনিট আগে মঞ্চ থেকে নেমে গেলেন শাহ। ভাষণ শেষও করলেন খানিকটা আচমকাই। রাজ্য বিজেপির একটি সূত্রে দাবি করা হয়েছিল, অন্তত আধ ঘণ্টা বক্তৃতা করবেন শাহ। সেখানে সাকুল্যে ২৩ মিনিট ভাষণ দিয়েছেন শাহ। বেলা আড়াইটে নাগাদ সভাস্থল ছেড়ে তিনি রেসকোর্স হেলিপ্যাড হয়ে বিমানবন্দরের উদ্দেশে রওনা হয়ে যান।

Advertisement

রাজ্য বিজেপি নেতাদের একাংশের ব্যাখ্যা, একাধিক নির্বাচনী সভা করে শাহ ক্লান্ত ছিলেন। দিল্লিতে তাঁর জরুরি কাজও ছিল। তাই তিনি একটু আগে আগেই সভাস্থল ছেড়ে গিয়েছেন। কিন্তু এই সভার মূল আকর্ষণ ছিলেন শাহ স্বয়ং। যে কারণেই হোক, তাঁর মধ্যে এমন ‘গা-আলগা’ ভাব দেখা যাওয়াটা যে ‘বাঞ্ছনীয়’ নয়, তা একান্ত আলোচনায় অনেকেই মেনে নিচ্ছেন।

ভিড়ের বহর এবং স্বতঃস্ফূর্ততার অভাবে শাহকে কি খানিকটা আশাহত দেখিয়েছে? রাজ্য বিজেপি নেতারা সমস্বরে বলছেন, একেবারেই না! কিন্তু এটা গোটা ধর্মতলা দেখেছে যে, শাহ প্রকাশ্যেই বিস্ময় প্রকাশ করেছেন তাঁর সঙ্গে গলা মিলিয়ে ভিড়ের গর্জন শুনতে না-পেয়ে। বলেও ফেলেছেন, ‘‘বাংলার লোকেদের গলার জোর কোথায় গেল?’’

তবে ‘গলার জোর’-এর চেয়েও এই সভায় দরকার ছিল ‘সংগঠনের জোর’-এর। যে ‘জোর’ খাটিয়ে লোক জোগাড় করে গোটা মধ্য কলকাতা অচল করে দেওয়া যায়। বলা হয়, যে কোনও রাজনৈতিক কর্মসূচির সাফল্যের ‘সূচক’ হল আমজনতার ভোগান্তি। যে ভাবে রাজ্য বিজেপি হুঙ্কার দিয়েছিল, তাতে অনেকেই মনে করেছিলেন, যানজটে, মিছিলে, জনসমাগমে দুর্ভোগ হবে চূড়ান্ত। বুধবার মধ্য কলকাতার অনেক স্কুলে অঘোষিত ছুটিও দিয়ে দেওয়া হয়েছিল। বাস্তবে দেখা গিয়েছে, ভিক্টোরিয়া হাউসের সামনেটুকু বাদ দিলে প্রায় অন্যান্য দিনের মতোই থেকেছে ধর্মতলার চেহারা। শাহের বক্তৃতা শুরুর মিনিট দশেক আগেও লেনিন সরণি দিয়ে প্রায় নির্বিঘ্নেই যান চলাচল করেছে।

এর আগে শাহ ধর্মতলার ঠিক এই জায়গায় সভা করেছিলেন ২০১৪ সালের ৩০ নভেম্বর। তখন রাজ্য বিজেপির সভাপতি রাহুল সিংহ। একমাত্র বিধায়ক শমীক ভট্টাচার্য। সদ্য দলের কাজে আসা দিলীপ ঘোষ কোনও দায়িত্ব পাননি। বুধবার মঞ্চে সেই তিন জনই উপস্থিত ছিলেন। তাঁরা অতীতের সেই সভার কথা উল্লেখও করেছেন। সে বার এই সভা থেকে বিজেপির তৎকালীন পর্যবেক্ষক তথা এখন উত্তরপ্রদেশের মন্ত্রী সিদ্ধার্থনাথ সিংহ ‘ভাগ মুকুল ভাগ’ স্লোগান তুলেছিলেন। বুধবারের সভায় রাজ্য বিজেপির অনেকেই ‘ভাগ মমতা ভাগ’ বা ‘ভাগ ভাইপো ভাগ’ স্লোগান শোনার আশা করেছিলেন। কিন্তু শাহ সে সবের ধারপাশ দিয়ে যাননি।

তবে শাহ নিজেও তাঁর বক্তৃতায় ২০১৪ সালের সেই সভার উল্লেখ করেছেন। তখনকার থেকে বিজেপির শক্তিবৃদ্ধির পরিসংখ্যানও দিয়েছেন। শাহ বলেন, ‘‘আমি ২০১৪-এ এখানে এসেছিলাম। বাংলার মানুষকে দায়িত্ব দিয়েছিলাম তৃণমূলকে হটানোর। আমি বাংলার মানুষকে ধন্যবাদ দেব ১৮ জন সাংসদ এবং ৭৭ জন বিধায়ক দেওয়ার জন্য। বাংলার মানুষ ২ কোটি ৩০ লক্ষ ভোট দিয়েছেন।’’

জমায়েতে আসা অনেকেই বলছেন, শাহের বক্তৃতায় ‘নতুন কিছু’ শোনার আশা ছিল তাঁদের। কর্মী-সমর্থকরা তো বটেই, রাজ্য নেতাদেরও অনেকে আশা করেছিলেন, বিভিন্ন কেন্দ্রীয় তদন্তকারী সংস্থা তৃণমূলের নেতা এবং মন্ত্রীদের বিরুদ্ধে ওঠা অভিযোগের প্রেক্ষিতে আরও সক্রিয় হবে কি না, কেমন পরিণতি হতে পারে, সে ব্যাপারে কোনও ইঙ্গিত দেবেন শাহ। মঙ্গলবারেই রাজ্য বিজেপির সভাপতি সুকান্ত মজুমদার বলেছিলেন, ‘‘চোরেরা যে আগামী দিনে জেলে যাবে, যেটা বাংলার মানুষ চাইছে সেই আশ্বাসও তিনি দেবেন।’’ কিন্তু সে পথে আদৌ হাঁটেননি কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী। শুধু মমতার উদ্দেশে বলেন, ‘‘আপনার সাহস থাকলে জ্যোতিপ্রিয়, অনুব্রত, পার্থকে তৃণমূল থেকে সাসপেন্ড করুন। আপনি পারবেন না। যিনি নিজে দুর্নীতিগ্রস্ত তিনি এই রাজ্যকে দুর্নীতিমুক্ত করতে পারবেন না।’’ যদিও রাজ্য বিজেপির একাধিক নেতারই বক্তব্য, কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী হিসাবে যতটা বলা যায়, তিনি ততটাই বলেছেন। এক নেতার কথায়, ‘‘কী হবে আর কী হবে না, সে সব কথা কি আর প্রকাশ্য সভা থেকে বলা যায়!’’

মমতা দিনরাত (ধৃত নেতা-মন্ত্রীদের উদ্দেশে) ‘ভাইপোর নাম বলে দিও না’ বলে দুর্গানাম জপ করেন বলে উল্লেখ করেন শাহ। মহুয়া মৈত্রের নাম না নিলেও বলেন, ‘‘তৃণমূল সাংসদ সংসদকেও অপবিত্র করেছেন।’’

সাম্প্রতিক এই দু’টি বিষয় ছাড়া শাহ যা যা বলেছেন, তা আগেও তাঁর মুখে শুনেছে বাংলা। সংশোধিত নাগরিকত্ব আইন (সিএএ) চালুর কথা গত বিধানসভা নির্বাচনের সময় থেকেই বলছেন। বুধবারও বলেছেন। ইউপিএ জমানায় বাংলা কেন্দ্রের থেকে কোন খাতে কত টাকা পেয়েছে আর মোদী সরকার কত দিয়েছে সে পরিসংখ্যান বুধবারের মতো অতীতেও শুনিয়েছেন। অনুপ্রবেশ, রাজনৈতিক সন্ত্রাসের পুরনো রেকর্ড বাজিয়েছেন বুধবারও।

অতীতে রাজ্যে এসে ২০২৫ সালেই তৃণমূল সরকার পড়ে যাবে বলে মন্তব্য করেছিলেন শাহ। বুধবার সে উচ্চারণ শোনা যায়নি। বরং লোকসভা নির্বাচনে বড় সংখ্যায় আসনের পাশাপাশি ২০২৬ সালের বিধানসভা নির্বাচনে দুই-তৃতীয়াংশ গরিষ্ঠতার লক্ষ্য বেঁধে দিয়েছেন। তবে তাঁর ‘পাখির চোখ’ যে আগামী লোকসভা নির্বাচনে ক্ষমতায় ফেরা, সেটা স্পষ্ট করেছেন। তবে অতীতে বাংলায় এসে যে ৩৫ আসনের লক্ষ্য বেঁধে দিয়েছিলেন সেটা আর বুধবার বলেননি। যা বেশ অবাক করার মতোই। তবে লোকসভা নির্বাচনে ভাল ফলের আর্জি জানিয়েছেন বাংলার মানুষের কাছে। সেই লক্ষ্যেই মোদীর নেতৃত্বে করোনার বিরুদ্ধে লড়াই থেকে ৩৭০ ধারার বিলোপ, চন্দ্রযানের সাফল্য, নতুন সংসদ ভবনের কথা শুনিয়েছেন। ভোলেননি আগামী ২২ জানুয়ারি অযোধ্যায় রামমন্দিরের ‘প্রাণপ্রতিষ্ঠা’ কর্মসূচির কথা বলতেও।

তবে ২১ জুলাইয়ের ‘মহড়া’ নেওয়ার যে চ্যালেঞ্জ ধর্মতলার সভা থেকে রাজ্য বিজেপি নিয়েছিল, সে কর্মখালিই থেকে গিয়েছে।

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement