বিদ্যাসাগর নন, কর্মাটাঁড়ের ‘ঈশ্বর’

বিদ্যাসাগরের কর্মবহুল জীবনে কর্মাটাঁড় পর্বটি খুব গুরুত্বপূর্ণ। এই পর্বে তাঁকে আমরা নতুন ভাবে খুঁজে পাই। অনেকে বলে থাকেন এই পর্বটি তাঁর ‘নিঃসঙ্গ’পর্ব। কিন্তু এখানে এসেই তিনি যেন তাঁর প্রকৃত সঙ্গীদের খুঁজে পান। লিখছেন জয়ন্ত সিংহ মহাপাত্রবিদ্যাসাগর এখানে আসার পরেই এই অঞ্চলের আর্থ-সামাজিক বাস্তবতা তাঁকে ভাবাতে শুরু করে। অল্প সময়ের মধ্যেই তিনি এখানকার গরিব প্রান্তিক মানুষদের পরম বন্ধু হয়ে উঠলেন। এখানকার হতদরিদ্র মানুষদের জীবন ও জীবিকার দায়িত্ব তুলে নিলেন নিজের কাঁধে। দান নয়, পথ দেখালেন জীবিকা অর্জনের। পাঠ দিলেন আত্মমর্যাদা বোধের। তাঁদের নিয়ে শুরু করলেন উদ্যানপালন ও কৃষির কাজ।

Advertisement
শেষ আপডেট: ৩০ নভেম্বর ২০১৯ ০৭:৪৮
Share:

ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর।

১২৭৩ বঙ্গাব্দের ২৫ অগ্রহায়ণ। পিতা ঠাকুরদাস বন্দ্যোপাধ্যায়কে একটি চিঠিতে বিদ্যাসাগর লিখছেন, ‘নানা কারণে আমার মনে সম্পূর্ণ বৈরাগ্য জন্মিয়াছে। আমার ক্ষণকালের জন্যও সাংসারিক কোন বিষয়ে লিপ্ত থাকিতে বা কাহারও সহিত কোন সংস্রব রাখিতে ইচ্ছা নাই। বিশেষতঃ ইদানীং আমার মনের ও শরীরের যেরূপ অবস্থা ঘটিয়াছে, তাহাতে সাংসারিক বিষয়ে সংশ্লিষ্ট থাকিলে অধিক দিন বাঁচিব এরূপ বোধ হয় না। এজন্য স্থির করিয়াছি, যতদূর পারি নিশ্চিন্ত হইয়া জীবনের অবশিষ্ট ভাগ নিভৃতভাবে অতিবাহিত করিব।’

Advertisement

বিদ্যাসাগর যে সময়পর্বে চিঠিটি লিখছেন, সে সময়ে নানা কারণে তাঁর মনে ক্ষোভের সঞ্চার হয়েছে। প্রধান কারণ, ক্ষীরপাইনিবাসী মুচিরাম বন্দ্যোপাধ্যায় ও কাশীগঞ্জের বাল্যবিধবা মনমোহিনীদেবীর বিয়েকে কেন্দ্র করে দ্বন্দ্ব-সংঘাত ও তার জন্য ভাই শম্ভুচন্দ্রের দাদা ঈশ্বরচন্দ্রকে দোষারোপ। এ ছাড়া, ভাই দীনবন্ধুর বিদ্যাসাগরের বিরুদ্ধে সম্পত্তি নিয়ে মামলা, পুত্র নারায়ণচন্দ্রের খারাপ ব্যবহার, স্ত্রী দীনময়ীদেবীকে শিক্ষিত করে তোলা নিয়ে মায়ের সঙ্গে মতবিরোধ, পরে সংস্কৃত-যন্ত্র ছাপাখানা ও বইয়ের সত্ত্বকে কেন্দ্র করে বন্ধু মদনমোহন তর্কালঙ্কার ও বন্ধু-জামাতা যোগেন্দ্রনাথ বিদ্যাভূষণের সঙ্গে মতবিরোধ—এ সব নানা কারণে আত্মীয়স্বজন-সুশীল সমাজ ত্যাগ করে আত্মাভিমানী বিদ্যাসাগর চলে যান আর্থিক ভাবে দুর্বল, জাতিগত ভাবে নিম্নবর্গীয় প্রান্তিক মানুষদের কাছে, কর্মাটাঁড় অঞ্চলে।

বিদ্যাসাগরের কর্মবহুল জীবনে কর্মাটাঁড় পর্বটি খুব গুরুত্বপূর্ণ। এই পর্বে বিদ্যাসাগরকে আমরা নতুন ভাবে খুঁজে পাই। অনেকে বলে থাকেন এই পর্বটি তাঁর ‘নিঃসঙ্গ’পর্ব। কিন্তু লক্ষণীয় বিষয় এই যে, এখানে এসে বিদ্যাসাগর যেন তাঁর প্রকৃত সঙ্গীদের খুঁজে পেলেন। এই অঞ্চলের অধিকাংশ অধিবাসী সাঁওতাল। মধ্যবিত্ত, শিক্ষিত শ্রেণির মানুষের সংখ্যা হাতেগোনা। শিক্ষা, স্বাস্থ্য, জীবিকা—সব দিক থেকে তাঁরা বঞ্চিত। প্রকৃতিও বিরূপ। পাথর ও কাঁকর মেশানো মাটি চাষবাসের পক্ষে একেবারে অনুপযুক্ত। ফলে, এ অঞ্চলের মানুষদের জীবিকার সন্ধানে যেতে হত দূরবর্তী অঞ্চলে।

Advertisement

বিদ্যাসাগর এখানে আসার পরেই এই অঞ্চলের আর্থ-সামাজিক বাস্তবতা তাঁকে ভাবাতে শুরু করে। অল্প সময়ের মধ্যেই তিনি এখানকার গরিব প্রান্তিক মানুষদের পরম বন্ধু হয়ে উঠলেন। এখানকার হতদরিদ্র মানুষদের জীবন ও জীবিকার দায়িত্ব তুলে নিলেন নিজের কাঁধে। দান নয়, পথ দেখালেন জীবিকা অর্জনের। পাঠ দিলেন আত্মমর্যাদা বোধের। তাঁদের নিয়ে শুরু করলেন উদ্যানপালন ও কৃষির কাজ।

১৮৭৩ সাল। বিদ্যাসাগর যে সময়ে কর্মাটাঁড়ে বসবাস শুরু করছেন, সে সময়ে রেল প্রতিষ্ঠা এবং ফ্রান্স ও ইংল্যান্ডের লাগাতার যুদ্ধে রণতরী তৈরির জন্য বিপুল পরিমাণ গাছপালা ধ্বংস হয়েছিল ছোটনাগপুর অঞ্চলের অরণ্যে। ফলে, এক দিকে প্রাকৃতিক ভারসাম্য যেমন নষ্ট হয়েছিল, তেমনই টান পড়েছিল আদিবাসীদের বনজ খাদ্যের জোগানে।

অনুর্বর অঞ্চলে কৃষিকাজের সম্ভাবনা কম ছিল বলেই বিদ্যাসাগর জোর দিয়েছিলেন উদ্যানপালনে। কর্মাটাঁড়ে তাঁর নন্দনকাননে আম, জাম, কাঠাঁল, বেলের পাশাপাশি বেগুন, লাউ, কুমড়ো, পালং, পাট ও প্রচুর ফুলের গাছও লাগিয়েছিলেন। কলকাতা থেকে উন্নত বীজ এনে তা বাগানে রোপণ করতেন। এ সব কাজে শ্রমিক হিসাবে নিয়োগ করতেন স্থানীয় মানুষদের। পারিশ্রমিক দিতেন যথেষ্ট। প্রাকৃতিক দুর্যোগের কারণে কাজে ব্যাঘাত ঘটলেও পারিশ্রমিকে কোপ পড়ত না। তাঁর লক্ষ্য ছিল তাঁদের মর্যাদার সঙ্গে স্বনির্ভর করা।

অর্থ ও উৎসাহ পেয়ে শ্রমজীবী মানুষেরাও তাঁকে ভরসা করে কৃষিকাজে মন দিতে শুরু করেন। অনুর্বর জমিকে চাষযোগ্য করে তুলতে বিদ্যাসাগর শ্রমিকদের নানা পরামর্শও দিতেন। কলকাতা থেকে ভাল বীজ এনে বিতরণের পাশাপাশি অনুর্বর জমিকে চাষযোগ্য করে তোলার জন্য এক বুক সমান মাটি খুঁড়ে সেই গর্তে বাইরে থেকে ভাল মাটি এনে ভরাট করাতেন। তার পরে রোপণ করা হত বীজ। শ্রমসাধ্য কাজ হলেও বিদ্যাসাগর হাল ছাড়তেন না। মনেপ্রাণে চাইতেন, এই প্রান্তিক গরিব মানুষগুলো নিজের পায়ে দাঁড়াক, সম্মান নিয়ে বাঁচুক।

কৃষ্ণচন্দ্র ঘোষাল ‘সঞ্চিতা’ পত্রিকায় ‘বিদ্যাসাগর ও কর্মাটাঁড়’ প্রবন্ধে লিখেছেন, ‘তিনি (বিদ্যাসাগর) নিজে গরীব গৃহস্থের সন্তান ছিলেন, গরীবকে কোন কোন প্রচেষ্টার দ্বারা বাঁচাতে হয় তা জানতেন এবং লোককে সেই বিষয়ে কার্যকরী ভাবে হাতে-কলমে শিক্ষা দিতেন।’ ঈশ্বরচন্দ্র হয়ে উঠেছিলেন তাঁদের কাছে

প্রকৃত ‘ঈশ্বর’।

১৮৬৯ সালের জুনে বিদ্যাসাগর আত্মীয়দের কাছে আঘাত পেয়ে বীরসিংহ চিরকালের জন্য ত্যাগ করেন। বিদ্যাসাগরের ভাই শম্ভুচন্দ্র বিদ্যারত্ন তাঁর ‘বিদ্যাসাগর জীবনচরিত ও ভ্রমনিরাস’ গ্রন্থে লিখছেন, তাঁর দাদা তাঁদের উদ্দেশ্যে বলেছিলেন ‘তোমরা আমাকে দেশত্যাগী করাইলে।’ বিদ্যাসাগর দেশ ছেড়েছিলেন ঠিকই, কিন্তু পেয়েছিলেন প্রকৃত স্বজন। জন্ম হয়েছিল নতুন ঈশ্বরের। তিনি ‘বিদ্যাসাগর’ নন, মাটিমাখা ঈশ্বর।

লেখক পুরুলিয়ার মহাত্মা গান্ধী কলেজে বাংলার শিক্ষক

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement