প্রস্তুতি: সিউড়িতে মোক্তার কালী প্রতিমা গড়তে ব্যস্ত শিল্পী। নিজস্ব চিত্র
আসর বসেছে কবিগানের। হাত জোড় করে দর্শকদের কাছে কবিয়ালের মিনতি, ‘আজ কী পালা শোনাব বাবুমশাইরা?’
জনতার মধ্যে থেকে আওয়াজ উঠল— ‘সেই, হিন্দু-মুসলমান পালাটা হোক।’ কোমর বেঁধে তৈরি হয়ে গেলেন বীরভূমের খরুণ গ্রামের কবিয়াল লম্বোদর চক্রবর্তী। গাইলেন মুসলমানের পক্ষে। প্রতিপক্ষ বিখ্যাত মুসলিম কবিয়াল মুর্শিদাবাদের গোমানি শেখ করলেন হিন্দুদের গুনগান। আসর শেষে উভয়ে উভয়কে জড়িয়ে ধরলেন।
প্রায় দেড়শো বছর আগে অধুনা জেলাশহর সিউড়িতে এমনই সম্প্রীতির আবহে বৈশাখের প্রথম শনিবার ‘মোক্তার কালী’ পুজোর প্রচলন। এতগুলি বৈশাখ পেরিয়ে সে পুজো সর্বজনীন হলেও, এখনও ভাটা পড়েনি আগ্রহে। আজ, শনিবার সেই পুজোয় মাতবে সিউড়িবাসী।
কী ভাবে পুজো শুরু হল সেই গল্প শোনালেন সিউড়ির বর্ষীয়ান উকিল আদ্যনাথ চট্টোপাধ্যায়। তিনি আবার এখনকার পুজো কমিটির সম্পাদকও। তাঁর কথায়, ১২৮০ বঙ্গাব্দে কাটোয়া থেকে কালীভক্ত নবীনচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় রুজির খোঁজে সিউড়ি এসে মোক্তারি পেশা বেছে নেন। সে আমলে সিউড়ির কালেক্টারেটে সরাসরি খাজনা দেওয়া যেত না। আম-মোক্তারের মাধ্যমে সরকারি কোষাগারে খাজনা জমা পড়ত। সেই সময়ে শহরে বিনোদনের তেমন ব্যবস্থা ছিল না। রক্ষাকালী আর বামনি কালী ছাড়া তেমন পুজোও ছিল না। এমন সময়ে মোক্তারদের বিনোদনের জন্য প্রচলন হয় কালীপুজোর। পুজোর দিন ঠিক হয় বৈশাখের প্রথম শনিবার। তাতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নেন নবীনচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়, বেচারাম মুখ্যোপাধ্যায়-সহ অন্য মোক্তাররা। পেশার নামে কালীর নাম হয় ‘মোক্তার কালী’। মন্দির তৈরি হয় জমিদার দক্ষিণারঞ্জন মুখোপাধ্যায়ের দানের জমিতে। সারা বছর ধরে যে স্ট্যাম্প পেপার বিক্রি হত, তার লভ্যাংশ তুলে রাখা হত পুজোর জন্য। এ ছাড়া সে আমলের ঘনশ্যাম পৈতণ্ডী, কানাভোলা, রাখু, পাঁচুবাবুদের মতো মোক্তারদের সক্রিয় সহযোগিতায় পুজো চলতে থাকে।
আদ্যনাথবাবু বলেন, “শনিবারের রাতে পুজো শুরু হয়ে শেষ হতে হতে রবিবার সকাল হয়ে যেত।’’ পুজোর পরের দিন, রবিবার মালিপাড়ার শক্তি অপেরার যাত্রা বসত। পরে যাত্রা পালার সঙ্গে সঙ্গে চালু হয় কবিগানের আসর। সেই সময় ‘হিন্দু মুসলমান’, ‘কংগ্রেস-কমিউনিস্ট’ এই সব পালা দেখতে ভিড় উপছে পড়ত। মোক্তারবাবুদের বিশ্রামের জন্য সোমবার জেলা জুড়ে সরকারি ছুটি ঘোষণা করা হত। মোক্তারের সংখ্যা কমতে থাকলে এই পুজো সোনাতোড় পাড়ার ছেলেদের হাতে তুলে দেওয়া হয়। তখন থেকে এই পুজো সর্বজনীনের তকমা পায়।
পুজোর দায়িত্বে থাকা বিরুপাক্ষবাবু জানান, আগে বলিদান প্রথা থাকলেও এখন আর তা হয় না। মুহুরি মহাদেব দত্ত, সাধন চট্ট্যোপাধ্যায়রা জানান, রীতি মেনে এখনও সর্বজনীন পুজোয় চাঁদা দেন উকিলরা। এ বছরের পয়লা বৈশাখ শনিবার হওয়ায় পুজো পরেছে প্রথম দিনেই। তাই আনন্দে আত্মহারা পায়েল, গায়ত্রী, মধুমিতা, করবীর মতো কচিকাচারাও। নবীনচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের উত্তরসূরি অসীমবাবু জানান, এই পুজো সর্বজনীন হলেও পরিবারে সঙ্গে ওতপ্রোত ভাবে জড়িয়ে আছে।
শনিবার বিকেলে প্রতিমা আনা হয়। পুজো শেষে বুধবার বিকেলে শহরের মোক্তারদের বাড়ি বাড়ি প্রতিমাকে ঘোরানো হয়। মহিলারা আলতা সিঁদুর দিয়ে মাকে বিদায় জানান। সব শেষে শহর ঘুরে মন্দিরের কাছে কুম্মিলা পুকুরের জলে প্রতিমা বির্সজন হয়। ঠিক যেমনটা হত দেড়শো বছর আগেও!