সহজ-পাঠ: মানবাজারের বনমহড়া প্রাথমিক স্কুল। ছবি: সমীর দত্ত
মাথার উপরে বড় গাছ। তার ছায়ায় ঝকঝকে নিকানো উঠোনে বসে কচি ছেলেমেয়েরা সুর করে নামতা পড়ছে। কেউবা খাতায় অঙ্ক কষছে। যেন শান্তিনিকেতনের টুকরো ছবি। তা অবশ্য নয়। মানবাজার ১ চক্রের বনমহড়া প্রাথমিক স্কুলের ঘটনা। এ কি প্রকৃতির কোলে থেকে পাঠ নেওয়া? তাও নয়। আপাত ভাবে শিক্ষাদানের দৃশ্য নয়ন মনোহর হলেও আসল সত্যিটা হল এখানে স্কুলের নিজস্ব কোনও ভবনই নেই। ভরসা তাই গাছতলাই। ২০১৪ সাল থেকে এ ভাবেই চলছে স্কুল।
বনমহড়া প্রাথমিক স্কুলে শিক্ষক-শিক্ষিকা দু’জন। ছাত্র সংখ্যা ৫০। পড়ুয়ারা প্রায় সবাই তফসিলি জাতির। মানবাজার-দোলাডাঙা রাস্তা থেকে প্রায় এক কিমি মাটির রাস্তা উজিয়ে গাছতলার এই স্কুল।
স্কুলের প্রধান শিক্ষক সৌমাল্য মাহাতো জানান, ২০১৪ সালের জানুয়ারি মাস থেকে এ ভাবেই স্কুল চলে আসছে। জমি জটিলতায় আর স্কুল ভবন গড়ে ওঠেনি। বাধ্য হয়ে এ ভাবেই তাঁরা গাছতলায় ক্লাস নিচ্ছেন। শিক্ষিকা পিঙ্কু সিংহ বলেন, ‘‘স্কুলের নিজস্ব ভবন না থাকায় শৌচালয় নেই। এতে আমার বেশ সমস্যা হয়। শুনেছি জেলা প্রাথমিক শিক্ষা দফতর স্কুল ভবনের জন্য জায়গা দেখছেন।’’
আপাতত গ্রামের এক সাধুর আশ্রমে গাছতলায় স্কুল চলে আসছে। প্রধান শিক্ষক বলেন, ‘‘আশ্রমের ঘরেই স্কুলের বই-খাতা, মিড-ডে মিলের রান্নার সরঞ্জাম সব রাখা থাকে।’’
গাছতলায় চেয়ারে বসেন শিক্ষক-শিক্ষিকার। মাটিতে চট বিছিয়ে চলে সব শ্রেণির ক্লাস। ফলে বৃষ্টি নামলেই পড়াশোনা লাটে ওঠার জোগাড় হয়। পড়ুয়ারা বই-খাতা নিয়ে দৌড় লাগায়। চতুর্থ শ্রেণির সোমা বাউরি, তৃতীয় শ্রেণির তপন বাউরি, আকাশ বাউরি বলে, ‘‘আকাশে মেঘ দেখলেই আমরা বই বগলে সাধুর ঘরে গাদাগাদি করে ঢুকে যাই। বৃষ্টি ধরলে বাইরে বেরোই। তখন অবশ্য জল-কাদায় পড়তে বসার মতো জায়গা থাকে না।’’
আশ্রমের বাসিন্দা এক প্রবীণা জানান, কয়েক বছর আগে গ্রামে জায়গা না মেলায় স্কুলটি অন্যত্র চলে যাচ্ছিল। তাই তাঁরা আশ্রমেই ওই স্কুলটি চালাতে বলেন। তা না হলে গ্রামের ছেলেমেয়েদের দূরে পড়তে যেতে হতো।
মানবাজার ১ চক্রের অফিস সূত্রে জানা গিয়েছে, ২০১৪ সালে স্কুলটি অনুমোদনের সময় ভবনের জন্য যে জমি দেখানো হয়েছিল, সেখানে আইনি জটিলতা রয়েছে। তাই সেই জমিতে ভবন গড়ার অনুমতি মেলেনি।
সম্প্রতি মানবাজার ১ চক্রের একটি প্রাথমিক স্কুল কেন্দ্রীয় সরকারের স্বচ্ছ বিদ্যালয়ের পুরস্কার পেয়েছে। সেই চক্রেই আবার গাছতলায় স্কুল চলে! এ কথা জেনে জেলা প্রাথমিক শিক্ষা সংসদের সভাপতি হেমন্ত রজক বলেন, ‘‘এই স্কুলটির খবর আমার জানা ছিল না। সমস্যা কাটাতে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেব।’’
মানবাজার ১ চক্রের অবর বিদ্যালয় পরিদর্শক ইরা সুবুদ্ধি অবশ্য শীঘ্র স্কুলের ভবন হবে বলে আশ্বাস দিয়েছেন। তিনি বলেন, ‘‘ওই স্কুলের ভবন নির্মাণের জন্য টাকাও বরাদ্দ হয়েছে। কিন্তু ভবন গড়তে গিয়ে দেখা গেল, যিনি জমি দিতে চাইছেন, তাঁর নামে রেকর্ড নেই। ফলে ওই দান আইনসঙ্গত নয়। ভবন নির্মাণের জন্য সরকারি খাস জমির সন্ধানে ছিলাম। ব্লক ভূমি ও ভূমি সংস্কার দফতর আমাদের এ রকম একটি জায়গার সন্ধান দিয়েছেন। সেখানেই স্কুল ভবন নির্মাণ করা হবে।’’ তবে স্কুলে যাতায়াতের জন্য রাস্তা সংস্কারের দরকার। তাই তাঁরা এ বিষয়ে স্থানীয় পঞ্চায়েতের সঙ্গে কথা বলছেন।