রাশ পড়ছে না এনআরসি-ভয়ে
Violence

‘চেষ্টা করেও আটকাতে পারিনি রোষ’

মল্লারপুর থানার গৌরবাজার গ্রামের লিলপাড়া এলাকার বাসিন্দা গালেবুল ইসলামের বাড়ির চেহারা এখন এমনই। দেখে কে বলবে, কয়েক ঘণ্টা আগেও এই বাড়িটা আস্ত ছিল! 

Advertisement

অপূর্ব চট্টোপাধ্যায়

মল্লারপুর শেষ আপডেট: ২৩ জানুয়ারি ২০২০ ০১:৫৫
Share:

হামলা: বাড়িতে চড়াও জনতা। নিজস্ব চিত্র

বুধবার দুপুর দুটো। তখনও বাড়ির পাশে পোড়া খড়ের পালুই থেকে ধোঁয়া বেরোচ্ছে। একতলা পাকা বাড়িটা পুড়ে কালো হয়ে গিয়েছে। একটু আগেই রামপুরহাট থেকে দমকলের একটি ইঞ্জিন আগুন নিভিয়ে গিয়েছে। পোড়া বাড়ির সামনে ধ্বংসস্তূপের মতো উঠোনে পড়ে আছে ভাঙা সাইকেল, কাঠের চৌকি, রান্নার গ্যাসের সিলিন্ডার—সব পোড়া! পড়ে আছে পোড়া কয়লা ও কাঠ। লোহার গেট পেরিয়ে বাড়িতে ঢুকে দেখা গেল, মেঝেয় পড়ে পোড়া লোহার আলমারি, বিছানা, অন্যান্য আসবাবপত্র। দু’টি ঘরের মধ্যে একটিতে দগ্ধ কম্পিউটার, ফ্রিজ, জেরক্স মেশিন, টিভি। অন্য ঘরে পোড়া বাইক। জামাকাপড়ও ছাই।

Advertisement

মল্লারপুর থানার গৌরবাজার গ্রামের লিলপাড়া এলাকার বাসিন্দা গালেবুল ইসলামের বাড়ির চেহারা এখন এমনই। দেখে কে বলবে, কয়েক ঘণ্টা আগেও এই বাড়িটা আস্ত ছিল!

অভিযোগ, এ দিন সকাল দশটা নাগাদ গ্রামেরই হাজার খানেক বাসিন্দা জড়ো হয়ে ওই বাড়িতে ভাঙচুর চালিয়ে আগুন লাগিয়েছেন। বাড়ির বাথরুম থেকে জলে পাম্প লুট হয়েছে। বিক্ষোভকারীদের অভিযোগ, গালেবুলের একমাত্র মেয়ে হাসনেবানু খাতুন এলাকার মহিলাদের ইন্টারনেট প্রশিক্ষণ দেওয়ার নাম করে এনআরসি এবং সিএএ-র জন্য তথ্য সংগ্রহ করে কেন্দ্রে তথ্য পাঠাতেন।

Advertisement

ঠিক কী ঘটেছিল?

মঙ্গলবার সন্ধ্যা থেকে গ্রামের মহিলাদের একাংশ প্রথমে হাসনেবানুর বাড়ি যান। একে একে গ্রামের পুরুষরাও জড়ো হন। শুরু হয় বাড়ি ঘেরাও। পরিস্থিতি খারাপ হচ্ছে দেখে গ্রামের দু’জন সিভিক ভলান্টিয়ার, এক জন গ্রামীণ পুলিশকর্মী বাড়িতে পৌঁছে হাসনেবানু ও তাঁর বাবা-মাকে একটি ঘরে রেখে ভিতর থেকে তালা দিয়ে দেন। গভীর রাতে গ্রামের মানুষের রোষের হাত থেকে তিন জনকে উদ্ধার করে নিজেদের হেফাজতে নেয় পুলিশ। স্থানীয় সূত্রের খবর, এ দিন সকাল ছ’টা থেকে ফের বাড়ির সামনে জমায়েত শুরু হয়। কিছু পরেই গালেবুল ইসলামের বাড়িতে ভাঙচুর, অগ্নিসংযোগ শুরু হয়। হাজার মানুষের সামনে উপস্থিত জনা আটেক পুলিশ এবং চার জন সিভিক ভলান্টিয়ার কোনও প্রতিরোধই গড়ে তুলতে পারেননি। ঘটনার খবর পেয়ে ফের এসডিপিও (রামপুরহাট) সৌম্যজিৎ বড়ুয়ার নেতৃত্বে রামপুরহাট, মল্লারপুর, তারাপীঠ এবং মাড়গ্রাম থানা থেকে পুলিশ বাহিনী গ্রামে পৌঁছয়। ধীরে ধীরে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আসে। দুপুর একটা নাগাদ দমকলের ইঞ্জিন আগুন নেভানোর ব্যবস্থা করে।

স্থানীয় বাসিন্দাদের একাংশের অভিযোগ, গালেবুল এলাকার শ্রমিকদের দিয়ে বিড়ি বানান। দীর্ঘদিন থেকে বিড়ি শিল্পীদের সরকারি পরিচয়পত্র এবং বিড়ি শ্রমিকদের সরকারি সুযোগসুবিধা পাইয়ে দেওয়ার নাম করে টাকা তুলেছিলেন। গ্রামের ভিতরের বাড়িতে গালেবুলের প্রথম পক্ষের স্ত্রী থাকেন। দ্বিতীয় স্ত্রী এবং প্রথম পক্ষের মেয়ে হাসনেবানুকে নিয়ে গালেবুল গৌরবাজার গ্রামের এক প্রান্তে থাকেন। গালেবুলের বিরুদ্ধে ক্ষোভ জমছিলই। সম্প্রতি এনআরসি এবং সিএএ নিয়ে আতঙ্কের পরিবেশের মধ্যে গালেবুলের মেয়ে হাসনেবানু ‘ইন্টারনেট সাথী’ প্রকল্পে মহিলাদের প্রশিক্ষণ দিতে শুরু করেন। অভিযোগ ওঠে, ইন্টারনেটের প্রশিক্ষণের নামে ছবি ও তথ্য সংগ্রহের কাজ করছেন ওই যুবতী। তা থেকেই জনরোষ এমন চেহারা নেয় বলে স্থানীয় সূত্রে জানা যাচ্ছে।

গ্রামের পঞ্চায়েত সদস্য, তৃণমূলের মোহন শেখ বললেন, ‘‘আমি গ্রামের মানুষকে বোঝানোর অনেক চেষ্টা করেছিলাম। কিন্তু, জনরোষ আটকাতে পারিনি।’’

এ দিন দুপুরে গ্রামে গিয়ে দেখা গেল, পুলিশ টহল দিচ্ছে। গ্রামের মহিলারা কেউ কথা বলতে চাননি। দু-এক জন পুরুষ দাবি করলেন, গ্রামের মানুষ এনআরসি চাইছেন, এমন তথ্য ও ছবি গালেবুলের মেয়ে ইন্টারনেটে দিচ্ছিলেন। তাই নিয়ে ক্ষোভে মানুষ একজোট হয়ে যা করার তাই করেছে। মল্লারপুর থানায় গিয়ে গালেবুল বা হাসনেবানুর সঙ্গে দেখা করা যায়নি।

বিডিও (ময়ূরেশ্বর ১) গোরাচাঁদ বর্মণ বলেন, ‘‘এনআরসি, সিএএ নিয়ে গুজবে কান না দেওয়ার জন্য এলাকায় আগে প্রচার করা হয়েছে। আরও বেশি করে প্রচার চালিয়ে মানুষকে সচেতন করার প্রয়োজন আছে।’’

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement