অঙ্কন: কুণাল বর্মণ।
সেবার তেমন বৃষ্টি হয়নি। চাষাবাদও ভাল হয়নি তাই। চাষের সময়ে ধান খেতে সবুজ না দেখলে মন খারাপ হয়। প্রকৃতির মন খারাপের সঙ্গেই তখন মিশে থাকত আতঙ্ক। বিকেলের পর থেকেই থমথম করত এলাকা। সন্ধ্যের পর সব বাড়ির দরজায় খিল পড়ে যেত। তবুও বন্ধ দরজা ঠেলে একদিন আতঙ্ক ঢুকে পড়ল জবারানি বেসরার ঘরে। চিরস্থায়ী হয়ে। সেই আতঙ্ক থেকেই লেদাম গ্রামের বৃদ্ধাটি বলছিলেন, ‘‘রাত নামলে দরজায় আওয়াজ হলে কেঁপে উঠি এখনও।’’
পুরুলিয়ার কুমড়া গ্রাম পঞ্চায়েতের লেদাম। বান্দোয়ান ব্লকের সীমানা ছোঁয়া গ্রাম। বান্দোয়ান-ঝাড়গ্রাম রাস্তা ধরে খেড়িয়াডি মোড় থেকে ডান দিকে বাঁক নিয়ে ১৫ কিলোমিটার মতো উজিয়ে গ্রামটি। রাস্তার দু’পাশে ঘন জঙ্গল। খেড়িয়াডি, তাসগ্রাম, যশপুর, আমগোড়া, রাজাউলির মতো ছোট ছোট বসতকে প্রকৃতি যেন নিজের হাতে সাজিয়েছে। গাঁয়ের চৌহদ্দি ছাড়ালেই ওপারে বাঁশপাহাড়ি। প্রকৃতির এমন সাজানো এলাকায়, জঙ্গলের গাছগাছালির আলো ছায়ায় মিশে থাকত আতঙ্কও। যে আতঙ্কের নাম বনপার্টি।
২০১০ সালের ২২ অগস্ট। সন্ধ্যা ৭টা পেরিয়েছে সবে। টিভিতে কিছু একটা দেখছিলেন জবারানি। তখনই দরজায় কড়া নাড়ার শব্দ। বৃদ্ধা বললেন, ‘‘প্রথমে সাড়া দিইনি। ফের কড়া নাড়তেই বিদ্যুৎ চলে গেল। ছেলে ভিতর থেকেই বলল এখন অন্ধকার। দরজা খোলা যাবে না।’’ বাইরে থেকে ধমক আসে, ‘‘আমরা বনপার্টি।’’ দরজাটা খুলে দিতে হয়। ঘরে ঢুকে পড়ে জনাকয়েক। মুখ বাঁধা, হাতে বন্দুক। ঢুকেই ওরা জবারানির মেয়ে অনিমার নাম ধরে ডাকে। মেয়ে ঘর থেকে বেরিয়ে আসে। কথা আটকে যায় মায়ের।
পাশের বাড়ি থেকে অনিমার কাকা নন্দ বেসরাকেও ডাকতে বলেছিল। জবারানির বৌমা শঙ্করী বেসরা বললেন, ‘‘কাকার বেরোতে দেরি হচ্ছে দেখে ফের ধমক। আমার কোলে তখন মাস তিনেকের মেয়ে। মাঝে মাঝেই কেঁদে উঠছে। আমি ভয়ে মুখে হাত চাপা দিচ্ছি।’’ ঘর থেকে পিছমোড়া করে বেঁধে ছেলে জগন্নাথ ও অনিমাকে বার করে ওরা। জগন্নাথকে মারধর করে দরজার সামনে ফেলে রেখে যায়। ছেলের চিৎকারে জবারানি ছুটে বেরিয়ে আসেন। ‘‘তখন ছেলেকে ফেলে মেয়ে দেওরকে ওই দিকে নিয়ে গিয়েছিল’’—জঙ্গলের দিকে আঙুল তুলে দেখান তিনি। বলতে থাকেন, ‘‘ওখানে তখন একটা মহুল গাছ ছিল। সেখানেই বসিয়ে রেখেছিল। দু’জনের হাত পিছন দিকে বেঁধে জঙ্গলের দিকে নিয়ে যাওয়ার আগে ছেলে জানতে চায় দিদি কাকাকে কোথায় নিয়ে যাচ্ছ?’’ প্রশ্ন করায় ফের মারধর, শাসানো।
নন্দ, অনিমাদের বাড়ির কেউ সারারাত ঘুমোননি। মাছের তরকারি, ভাত হেঁশেলেই পড়েছিল। পরদিন ভোরে গ্রামের লোকজন খবর দেন, জঙ্গলে নন্দ বেসরার নলি কাটা দেহ পড়ে আছে। অনিমা আজও নিখোঁজ।
পাশের গ্রাম রাজাউলির অঙ্গনওয়াড়ি কেন্দ্রে কাজ পেয়েছিলেন অনিমা। অভাবের সংসারে প্রধান ভরসা ছিলেন। জঙ্গলের রাস্তা ধরে সাইকেলে কাজে যেতেন। ভালবাসতেন সেন্টারের খুদেগুলোকে।
অঙ্গনওয়াড়ি কর্মীদের বাম সংগঠনের সদস্যও ছিলেন। মেয়েকে যখন নিয়ে যাচ্ছে বনপার্টির লোকেরা চোখের দিকে তাকাতে পারেননি জবারানি। বৃদ্ধা বলে চলেন, ‘‘তারপরে জঙ্গলে, আত্মীয় স্বজনের বাড়িতে কত খুঁজেছি। পুলিশের কাছেও গিয়েছি। কত জায়গায় মানত করেছি। বেঁচে থাকলে এতদিনে নিশ্চয়ই বাড়ি ফিরে আসত।’’ অসহায় এক মায়ের গলা। পুলিশ জানিয়েছে, ‘মিসিং কেস’ হয়েই ফাইলবন্দি ওই ঘটনা। গোটা এলাকায় তল্লাশি চালিয়ে অনিমার খোঁজ পাওয়া যায়নি।
মাঝে মাঝে টিনের বাক্স থেকে মেয়ের কাগজপত্র আর ফ্রেমে বাঁধানো সাদাকালো ছবিটা বার করেন জবারানি। হাত বুলিয়ে যত্ন করে তুলে রাখেন। সাইকেলটা অনেকদিন আগলে রেখেছিলেন। কষ্ট দেয় বলে বছর কয়েক হল বাড়িতে আর রাখেননি সাইকেলটা।
পড়শিদের কথায়, ‘‘নন্দ হয়তো সিপিএম পার্টি করত, অনিমা তো রাজনীতি করত না। তবু কেন...।’’ স্বগতোক্তির স্বরে প্রশ্ন মায়েরও, ‘‘চোখের সামনে দিয়ে মেয়েটাকে তুলে নিয়ে গেল ওরা। কিছুই করতে পারলাম না। কী অপরাধ করেছিল মেয়েটা?’’
উত্তর কে দেবে?
মাওবাদী পর্বে টানা ১০ বছর ধরে নিখোঁজ পরিবারের একজন কাজ পেয়েছেন মুখ্যমন্ত্রীর ঘোষণা মতো। অনিমার ভাই জগন্নাথ স্পেশাল হোমগার্ড এখন। জবারানির বার্ধক্য ভাতা প্রাপকের তালিকায় নাম উঠেছে।
কিন্তু মেয়ে হারানো মায়ের ক্ষতিপূরণ? কোনও সন্ধ্যায় যদি দরজাটা ঠকঠক করে ওঠে! মেয়েটা বলে ওঠে, ‘মা কপাট খোলো।’’
জঙ্গলের দিকে তাকান বৃদ্ধা। যেদিক দিয়ে মেয়েকে নিয়ে গিয়েছিল ওরা।